
মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ মাধ্যম হচ্ছে বই। মানুষের প্রাপ্তি এবং বঞ্চনা, সফলতা ও ব্যর্থতা এবং আশা-আকাক্সক্ষার একত্র প্রকাশ হলো বই। বই মানুষকে পূর্ণতা দান করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় চিরকাল। তবে বই বিভিন্ন রকমের ও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক বা পাঠ্যবই। সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং তাদের সার্বিক চাহিদা মেটাতেই পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পঠিত বই। উৎকৃষ্ট বই হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের অনন্য ভূমিকা রয়েছে, যা পাঠে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানপিপাসা মেটে। শিক্ষার্থীদের সফলতার দিক লক্ষ করে, নির্দিষ্ট কারিকুলাম অনুযায়ী প্রখ্যাত শিক্ষকগণসহ শ্রেণি শিক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে এ পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়ে থাকে। পাঠ্যপুস্তক দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষার জন্য মৌলিক জ্ঞানের প্রসারে এবং শিক্ষামূলক কাঠামো গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন/বই নির্বাচন : উৎকৃষ্ট বই মানুষকে যেমনি প্রকৃত সুখ ও আনন্দ দান করে তেমনি পাঠ্যপুস্তকসমূহ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করে। পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া- যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও কার্যকারিতা নির্ধারণে আবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে। পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা হয়। যেমন : ১. শিক্ষাক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, ২. বিষয়বস্তুর গুণগত মান নির্ধারণ, ৩. সহজ ভাষা ও উপস্থাপন শৈলী, ৪. অনুশীলনী ও কার্যক্রম, ৫. চিত্র ও উদাহরণ, ৬. শিক্ষাবিদগণের মতামত, ৭. শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া।
অতএব, শিক্ষাজীবনে পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত বিষয়ের বহুমুখী জ্ঞানার্জনে সহায়তা করে; পাশাপাশি সৃজনশীল বই যা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট তা নির্বাচন করাও যুক্তিযুক্ত। শিক্ষাজীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে বই নির্বাচন করাই সমীচীন।
পাঠ্যপুস্তক কী বা কাকে বলে : শিক্ষাক্ষেত্রে নির্ধারিত শ্রেণির সংশ্লিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুযায়ী রচিত পুস্তককে পাঠ্যপুস্তক বলা হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তকের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আর এ পাঠ্যপুস্তক রচনায় সকল দেশেই কিছু নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। উদ্দেশ্যমুখী শিক্ষাক্রমের আলোকে বাছাইকৃত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী রচিত বই বা পুস্তককে পাঠ্যপুস্তক বলা হয়।
পাঠ্যপুস্তক এমন একটি বই যা সাধারণত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর পাঠদান করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়। পাঠ্যপুস্তক শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয় সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত ধারণা দিতে সহায়ক হয়। সাধারণত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে তথ্য, উদাহরণ, চিত্র এবং অনুশীলনী থাকে, যা শিক্ষার্থীদের বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে ও অনুশীলন করতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের এমনকি উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলক। সমাজ ও দেশের যুগোপযোগী চাহিদাকে সামনে রেখে নির্বাচিত শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্য বিষয়, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে এ বিশাল কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। আর উদ্দেশ্যমুখী এ শিক্ষাক্রমের সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাছাইকৃত পাঠ্যসূচি নিয়ে শিক্ষাপদ্ধতির উপযোগী করে উপস্থাপনকারী পুস্তককেই পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা : পর্যালোচনা শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুশীলন, সমস্ত বিষয় চর্চা, সর্বতোভাবে আলোচনা বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করাকে বোঝায়। পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা বলতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় বৈশিষ্ট্য, অঙ্গসংগঠন, ধারাবাহিকতা রক্ষা, উপস্থাপন কৌশল, সুখপাঠ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের বিচারবিশ্লেষণকে বোঝায়। এটি শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী, এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনার উদ্দেশ্য হলো পাঠ্যপুস্তকটি শিক্ষার্থীদের জন্য ঠিক কতটা উপযোগী এবং তা তাদের শেখার প্রক্রিয়ায় কতটা সহায়ক তা নির্ধারণ করা। পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে : বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ® ভাষা ও প্রকাশনার মান ® চিত্র এবং উদাহরণ ® অনুশীলনী ও প্রশ্ন ® শিক্ষাগত উপযোগিতা ® সামঞ্জস্য।
পাঠ্যপুস্তকটি শিক্ষাক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না এবং শিক্ষাক্রমের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক কি না তা পরীক্ষা করা। এভাবে পর্যালোচনা করার মাধ্যমে শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞগণ পাঠ্যপুস্তকের গুণগত মান ও উপযোগিতা নির্ধারণ করেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন বা পরিমার্জনের সুপারিশ করেন।
পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব : শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পাঠ্যপুস্তক অপরিহার্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া পাঠ্যসূচিও অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে এখনো অনেকে পাঠ্যপুস্তককে শিক্ষাক্রম মনে করেন। এটি শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ধারণা না থাকা বা পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারা থেকে হতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব অনেক এবং এটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরশীল। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করেই মূলত পাঠদান করে থাকেন। শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পাঠ্যপুস্তক পড়ে জ্ঞান লাভ করে এবং শিক্ষকপ্রদত্ত বাড়ির কাজ তৈরি করে।
অভিভাবকগণের দায়িত্ব : অভিভাবক পাঠ্যপুস্তক দেখে সন্তানদের লেখাপড়ায় সাহায্য করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যায়ন করার জন্য পরীক্ষকেরও পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক প্রশিক্ষকগণ পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নানা রকম গবেষণা করেন এবং তাঁদের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ও বক্তব্যকে শিক্ষার্থীদের সামনে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই তুলে ধরেন।
পাঠ্যপুস্তকের বৈশিষ্ট্য : শিক্ষার পূর্বনির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক সাধারণ ও বিশেষ উদ্দেশ্যসমূহকে সামনে রেখে নির্বাচন করা হয় শিখনফল। শিখনফলের নিরিখে তালিকাভুক্ত করা হয় ভাববস্তুর। ভাববস্তুর আলোকে নির্ণীত হয় বিষয়বস্তু। আর বিষয়বস্তুর সামগ্রিক চিত্র হিসেবেই লেখা হয়ে থাকে পাঠ্যপুস্তক।
পাঠ্যপুস্তকের কতিপয় সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক, কেননা এ পাঠ্যপুস্তকই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাক্রম ও শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন বা যোগসূত্র স্থাপনে বিশেষভাবে কাজ করে এবং জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিম্নে পাঠ্যপুস্তকের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মৌলিক ধারণা ও নীতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে শিক্ষার্থীদের বয়স, সামর্থ্য, ধারণক্ষমতা ও মানসিক পরিপক্বতা বিবেচনা করা হয়। ৩. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যসূচি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়। ৪. পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়গুলোর বিন্যাস শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় সহায়ক হবে। ৫. বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও আগ্রহ পূরণ করে থাকে। ৬. পাঠ্যপুস্তকটি মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সহায়ক হবে। ৭. পাঠ্যপুস্তক বিতর্কিত ধ্যানধারণা মুক্ত হবে। ৮. শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত উদ্দেশ্য ও শিখনফলের আলোকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্বাচিত হবে। ৯. পাঠ্যপুস্তকের আকার, আয়তন, ডিজাইন, বাঁধাই, মুদ্রণ, ছাপার অক্ষরের আকার, কাগজের মান, দাম ইত্যাদি যুক্তিসংগত ও যুগোপযোগী হবে। ১০. পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন উদাহরণ, প্রসঙ্গ, ছবি, চিত্র বা ডায়াগ্রাম দেওয়া হয়Ñ যা শিক্ষার্থীদের বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। ১১. প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ ও অনুশীলনমূলক প্রশ্ন দেওয়া হয় যা শিক্ষার্থীদের নিজেদের জ্ঞান পরীক্ষা করতে এবং অধ্যায়টি ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। ১২. পাঠ্যপুস্তকে শব্দকোষ ও নির্দেশিকা থাকে যা পাঠ্যবস্তুর বিশেষ শব্দ ও ধারণাগুলোর ব্যাখ্যা দেয়। ১৩. পাঠ্যপুস্তকগুলো নিয়মিতভাবে সংশোধিত হয় এবং নতুন তথ্য ও আবিষ্কার যুক্ত করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা সর্বশেষ তথ্য পায়। ১৪. পাঠ্যপুস্তকে রেফারেন্স এবং অতিরিক্ত পাঠের জন্য বই ও অন্যান্য সম্পদের তালিকা দেওয়া হয় যা শিক্ষার্থীদের আরো বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করতে সাহায্য করে।এই বৈশিষ্ট্যগুলো পাঠ্যপুস্তককে একটি কার্যকর শেখার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করতে সাহায্য করে।
শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ পুস্তক ব্যতীত শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান আহরণ সম্ভব নয়। অতএব, বাজারে নিকৃষ্ট মানের সহায়ক পুস্তকের কাছে দিনদিন পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার কমে যাচ্ছে, এটা রোধ করা জরুরি। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকার প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে সরবরাহ করছে, এটা সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। অতএব, পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব যাতে না কমে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সুশীল সমাজের প্রত্যেকের ভূমিকা থাকা জরুরি লেখক- ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দিকদর্শন প্রকাশনী লিঃ ও
গ্রন্থকুটির প্রকাশনা গ্রুপ, ই-মেইল-dikdarshon@gmail.com, dikdarshon@yahoo.com