তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আধুনিক জীবনধারায় আমাদের তাৎক্ষণিক যোগাযোগ, সীমানাহীন ও প্রায় সীমাহীন তথ্যপ্রাপ্তি এবং বিস্তৃত উদ্ভাবনী সেবার সুযোগ করে দিয়েছে। সাইবার স্পেস ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় ও বৈশ্বিক বিষয় পর্যন্ত ব্যাপকভাবে কার্যাবলী এবং সেবাকে পরিপূরক বা বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। তবে ব্যবসা, সরকার এবং সমাজের ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় এটি অপরাধীদের জন্য অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা ব্যাহত করার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। সাইবার অপরাধসমূহ অর্থনৈতিক ক্ষতি,ব্যাক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার লঙ্ঘন, মানসিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা, ব্যবসায়িক ক্ষতি,
জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি, পরিচয় চুরি,জালিয়াতি সর্বোপরি সমাজের উপর এক বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই সাইবার অপরাধের হুমকি মোকাবেলায় সচেতনতা, প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা ও আইনের কঠিন অনুশাসন বাস্তবায়ন করা বর্তমান প্রজন্মের কাছে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান সরকার "সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ "প্রণয়ন করেছেন; যা সাইবার নিরাপত্তা জোরদার ও ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা আইনের খসড়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে,তবে কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
ধারা ৩৬ অনুযায়ী, পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট ট্রাইবুনালে দাখিলের নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। যেহেতু পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি করার ফলে ব্যক্তির হয়রানির সুযোগ থাকে, তাই এ ধরণের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
ধারা ৪৮ এর উপধারা (৩) অনুযায়ী,বাজেয়াপ্তযোগ্য সাইবার উপকরণের পাশাপাশি যদি কোনো বৈধ উপকরণ পাওয়া যায় তবে সেগুলোও বাজেয়াপ্ত করা হবে। এটি কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কেননা, বৈধ উপকরণ যদি অপরাধ সংগঠনে ব্যবহৃত না হয় তাহলে সেগুলো জব্দ করার কোন প্রয়োজন নেই। এই বিধান প্রয়োগ করলে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসার কার্যক্রম অযথা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এছাড়া খসড়াই হুইসেল ব্লোয়ারদের সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়নি , যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাইবার অপরাধ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে তারা অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখতে আগ্রহ প্রকাশ নাও করতে পারে। পাশাপাশি সাইবার হামলার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গ্রাহকদের কাছে তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। নাগরিকের ডাটা,ডিজিটাল সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি গোপন না রেখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা দরকার।
বিশ্বব্যাপী পরিবহন ও স্বাস্থ্য খাত সাইবার হামলার বড় লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। গণপরিবহন ও হাসপাতালের মতো সংবেদনশীল অবকাঠামো সাইবার আক্রমণের শিকার হলে মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তাই সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিলে এ দুটি খাতের মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা প্রয়োজন।
"সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪"এর খসড়ায় তথ্যের গোপনীয়তার বিষয়টা আংশিকভাবে আসলেও এটি অধিকার এবং প্রযুক্তির নিরাপত্তার মধ্যে কতটুকু ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছে তা নিয়ে একটা আশংকা থেকেই যায়। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা আইন আগের আইনের কিছু দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলেও এটি যেন প্রকৃত অর্থে সঠিক প্রয়োগ ও অপব্যবহার রোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে,সেদিকে সরকার এবং সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর সজাগ দৃষ্টি কাম্য।