
চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আট কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ে ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। পতেঙ্গা ও লালখান বাজার ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে মাঝখানে কোথাও উঠার সুযোগ না থাকলেও একের পর এক ছিনতাই হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়েতে কয়দিন বিরতির পর পর ঘটছে ছিনতাই ও অপহরণের ঘটনা। আর এসব ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে বিদেশ ফেরত যাত্রীরা। এদিকে পতেঙ্গা ও বন্দর থানা পুলিশ দিনে এবং রাতে দুই শিফটে ডিউটি করছে এক্সপ্রেসওয়ের উপর।কিন্তু ছিনতাইকারীদের দৌরত্ব থামছেনা।
এ বিষয়ে পতেঙ্গা থানার ওসি কাজী মো. সুলতান আহসান উদ্দিন জানান, এক্সপ্রেসওয়েতে দিনের বেলায় পতেঙ্গা ও রাতের বেলায় বন্দর থানার দুটি টহল দল পালাক্রমে ডিউটি করছে।পুলিশ সজাগ রয়েছে। অন্যদিকে ডবলমুরিং থানার ওসি বাবুল আজাদ জানান, ফ্লাইওভারে উঠে ডিউটি করার আমাদের সুযোগ নেই। কারণ আমাদের উঠতে হলে পতেঙ্গা অথবা লালখান বাজারে যেতে হয়। তবে সম্প্রতি পতেঙ্গা ও বন্দর থানা পুলিশ ফ্লাইওভারে ডিউটি করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে- তার ১০টি যদি আপনি এনালাইসিস করেন- প্রায় সবগুলোই ঘটছে রাত ১০টার পর থেকে ভোরের মধ্যে। কারণ সেখানে আলোকায়ন, সিকিউরিটি ফোর্স, নজরদারির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। যারা অপরাধী তাদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা বসানো প্রয়োজন। পুলিশের নিয়মিত টহলের পাশাপাশি মোটরসাইকেল পেট্রোলিং বাড়ানো যায়। যারা টোল আদায় করেন- তারাও প্রাইভেট সিকিউরিটি ফোর্স রাখতে পারেন। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি- অপরাধীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে নজর দিলে সেখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমে আসবে।
জানা গেছে, তিন বছর আবুধাবি থেকে দেশে আসে সুমন দাশ। নগরীর দেওয়ানবাজারের বাসিন্দা অমল দাস ছেলেকে আনতে যান চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে। দীর্ঘদিন কাছে পাওয়া ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীরা প্রবাসী সুমনের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। গত ৬ আগস্ট রাত নয়টায় নগরীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

ওই রাতে পরিচিত একজন ট্যাক্সি চালক নিয়ে বিমানবন্দর থেকে সুমনকে আনতে গিয়েছিলেন তার বাবা। রাত আনুমানিক নয়টায় বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে। কিছুদূর চলার পর পেছন দিক থেকে আসা একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস ট্যাক্সিকে ধাওয়া করে। ট্যাক্সিটি না থামলে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে থামায়। মাইক্রোবাস থেকে মুখোশ পরা ৮/৯ জন ছেলে নেমে প্রথমে ট্যাক্সির কাঁচ ভেঙ্গে দেয়। তারা অস্ত্রের মুখে সুমনকে জিম্মি করে নগদ ৫০ হাজার টাকা, পাসপোর্ট ও লাগেজ কেড়ে নেয়। পরে তারা সুমনকে স্বর্ণ দেয়ার জন্য চাপ দেয়। এক পর্যায়ে ছিনতাইকারীরা ট্যাক্সি চালককে ছেড়ে দিয়ে সুমন ও তার বাবাকে মাইক্রোতে তুলে সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যায়। সুমনের কাছ থেকে তারা নগদ টাকা, পাসপোর্ট, লাগেজ সবকিছু কেড়ে নিয়ে রাত ১২ টার সময় ছেড়ে দেয়। পরে সীতাকুণ্ড এলাকায় ডেকে নিয়ে সুমনকে তার পাসপোর্ট ফেরত দেয়।
গত ২৭ অক্টোবর সকাল দশটায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরেন ইমরান মুন্না। সোলেমান নামে এক আত্মীয় বিমানবন্দর থেকে মুন্নাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তাদের বহনকরা সিএনজি ট্যাক্সি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাঠগড় বাজার অংশে পৌঁছালে তাদের গতিরোধ করা হয়। অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের অন্য একটি গাড়িতে তুলে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ঘণ্টাখানেক পর অক্সিজেন এলাকা থেকে অপহৃত মুন্নাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বায়েজিদ থানা থেকে সদ্য বদলিকৃত ইপিজেড থানার ওসি মো. মো. কামরুজ্জামান জানান, ঘটনার পর পর অক্সিজেন এলাকা থেকে সুমন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। প্রবাসীর খোয়া যাওয়া মালামালও উদ্ধার করা হয়েছিল। ঘটনার শিকার মুন্নাকে মামলা করার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি। কিন্তু তিনি মামলা করতে রাজি হননি।
এদিকে দুবাইয়ের চায়না মার্কেটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হাটহাজারীর মেখলের বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন রনি গত ১৪ জুলাই ভোরে তিনি শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামেন। বড় ভাইকে আনতে বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তিনিও দুইমাস আগে বাইরাইন থেকে দেশে আসেন। সাহাব উদ্দিন জানান, বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে সকাল সাড়ে আটটায় দুইভাই প্রাইভেটকারে হাটহাজারীর উদ্দেশ্যে রওনা হন। এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়ের টোল বক্স পার হয়ে আনুমানিক দ্ইু কিলোমিটার যেতেই একটি কালো মাইক্রোবাস তাদের প্রাইভেটকারের গতিরোধ করে।
মাইক্রো থেকে সাত আটজন যুবক নেমে ছুরি দিয়ে প্রথমে গাড়ির চাকা ফাংচার করে দেয়। আনুমানিক ৩০-৩৫ বছর বয়সী এসব যুবকদের হাতে হাতে ওয়াকিটকি ও অস্ত্র ছিল। তারা অস্ত্রের মুখে ১০০ গ্রাম স্বর্ণের অলংকার, একটি স্যামসাং ট্যাব, একটি আইফোন ১৬ প্রো ম্যাক্স, একটি স্যামসাং এস ২৪ আল্ট্রাসহ মোট পাঁচটি মুঠোফোন, ৫০০০ ইউএস ডলার, ৪৫০০ দিরহাম ও নগদ টাকা কেড়ে নেয়। এতে প্রায় ২৬ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হন তিনি। এ বিষয়ে প্রবাসী শাহাব উদ্দিন বলেন, তারা আমাদের দুই ভাইকে খুবই মারধর করেছে। নিরাপদ মনে করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমর ধারণা ভুল ছিল বলে তিনি জানান।