
চট্টগ্রামে এবারও বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে নগর পুলিশ। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সমন্বয় সভায় সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হলে আপত্তি জানান সংস্কৃতিজন কামরুল হাসান বাদল। জবাবে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেছেন, অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত হলে ঝুঁকি বাড়ে। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরীর দামপাড়ায় সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে ‘পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নিরাপত্তা সমন্বয় সভা’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়।
সভার শুরুতে সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তুলে ধরেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (অপারেশন) মো. জাহাঙ্গীর। এরপর আয়োজক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বরবারের মতো এবারও নগরীর তিনটি স্থানে বড় আকারে পহেলা বৈশাখের আয়োজন করা হচ্ছে। সিআরবির শিরিষতলায় নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম, ডিসি হিলে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এসব আয়োজন হবে। এর বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীত উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম প্রথমবারের মতো নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ মাঠে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করেছে।
নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রামের সংগঠক কবি কামরুল হাসান বাদল সভায় জানান, সিআরবি শিরিষতলায় প্রতিবছরের মতো এবারও ১৩ এপ্রিল বাংলা বর্ষবিদায় এবং ১৪ এপ্রিল নববর্ষ বরণের আয়োজন করেছে। বর্ষবিদায়ের আয়োজন ১৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা ৬টা কিংবা মাগরিবের নামাজের আগপর্যন্ত চলবে। পহেলা বৈশাখে সকাল ৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। চলবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। স্থানীয় মসজিদের সঙ্গে সমন্বয় করে আজান ও নামাজের সময় অনুষ্ঠানে বিরতি থাকবে বলে তিনি জানান।
বক্তব্যে কামরুল হাসান বাদল অভিযোগ করেন, সিআরবিতে পুলিশের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কারণে মূল মঞ্চ ঢাকা পড়ে যায়।
তিনি বলেন, সাত রাস্তার মোড় থেকে শিরিষতলার দিকে গেলে যে ঢালু পথটা দিয়ে মঞ্চের সামনে নামতে হয়, সেখানেই পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষটা করা হয়। এতে সাত রাস্তার মোড় কিংবা আশপাশ থেকে মূল মঞ্চটা আর দেখা যায় না। গতবছরও এভাবে করা হয়েছে। আমরা আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু তারপরও করা হয়েছে। অনুরোধ করব, সেখানে যে পুলিশ ক্যাম্পটা করা না হয়। একপাশে যেখানে জনসমাগম কম, সেখানে করা হলে আমাদের জন্যও সুবিধা, পুলিশের দ্রুত রেসপন্স করার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়।
জবাবে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেখানে কন্ট্রোল রুম করা হয়, সেখান থেকে মঞ্চসহ চারপাশ পর্যবেক্ষণ করা সহজ হয়। প্রয়োজনে পুলিশও দ্রুত সেখান থেকে রেসপন্স করতে পারে।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় মূল মঞ্চে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, এমন স্থানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন না করার নির্দেশনা দেন।
এদিকে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের পক্ষে সুচরিত দাশ খোকন সভায় জানান, প্রতিবছর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের দু’দিনের আয়োজন করলেও এবার তারা শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখের আয়োজন করছে। পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬টায় তাদের আয়োজন শুরু হবে। দুপুরে নামাজের বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫টার মধ্যে তাদের আয়োজন শেষ হবে।
জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রামের সংগঠক অনির্বাণ ভট্টাচার্য সভায় জানান, বর্ষবিদায়ের দিনে ১৩ এপ্রিল রাতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ডিসি হিলের সামনে নন্দনকানন এলাকায় সড়কে আলপনা আঁকা হবে। পরদিন সকাল ৮টায় এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ মাঠে পহেলা বৈশাখের আয়োজন শুরু হবে। পরিষদের শিল্পীরা প্রথমে দুই ঘন্টা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। এরপর বিরতি দিয়ে দুপুর দু’টায় আবার অনুষ্ঠান শুরু হবে। তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের পরিবেশনা নিয়ে থাকবে।
সভায় সিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নগর পুলিশ সিআরবি শিরিষতলা, ডিসি হিল ও শিল্পকলা একাডেমিকে মূল ভেন্যু ধরে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। অনুষ্ঠান চলাকালীন ডিসি হিল ও সিআরবি শিরিষতলা এলাকা পুরোপুরি যানবাহনমুক্ত থাকবে। ডিসি হিলের আশপাশে চারটি স্পট এবং সিআরবি শিরিষতলার আশপাশে তিনটি স্পটে পুলিশের ব্যারিকেড থাকবে, যাতে কোনো ধরনের যানবাহন প্রবেশ করতে না পারে।
প্রতিটি ভেন্যুতে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় জানান।
সভায় বলা হয়, প্রতিটি ভেন্যুতে থানার সার্বক্ষণিক টিম ও মোবাইল টিম, ফুট পেট্রোল, চেকপোস্ট, সাদা পোশাকে পুলিশ, ডিবি টিম, সোয়াট টিম, কুইক রেসপন্স টিম, ডগ স্কোয়াড কে-নাইন ও বোম্ব ডিজপোজাল ইউনিট মোতায়েন থাকবে। এছাড়া পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হবে। প্রবেশপথে আর্চওয়ে থাকবে, মেটাল ডিটেক্টর দিয়েও তল্লাশি করা হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সম্মুখ, মধ্য ও শেষ- তিনভাগে পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে সভায় জানানো হয়েছে। এছাড়া সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করা, আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রতিটি ভেন্যুতে সিসি ক্যামেরা ও পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করা, আজান-নামাজের সময় মাইক অথবা লাউডস্পিকার বন্ধ রাখাসহ ১১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা আছে, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রোগ্রাম শেষ করতে হবে। আশা করছি, প্রোগ্রাম কোনোভাবেই সন্ধ্যা ৬টার পর যাবে না।
সময় বেঁধে দেয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সভায় কবি কামরুল হাসান বাদল বলেন, প্রতিবছর পুলিশের পক্ষ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। আমরাও অবশ্য সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি, কারণ আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই শহরে তো অনেক প্রোগ্রাম হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত হয়, সারারাতও চলে। তাহলে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে এত বিধিনিষেধ কেন ?
জবাবে সিএমপি কমিশনার বলেন, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে, এটা কোনো আইন না। প্রেক্ষিত বিবেচনায় এটা করা হয়েছে। অনেকগুলো ভেন্যুতে অনুষ্ঠান হয়। আমাদের যেসব ফোর্স, তারা কিন্তু আগের রাত থেকে ডিউটি করে।
বাদল আবারও আপত্তি জানিয়ে বলেন, সারাবছরে তো খুব বেশি এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় না। বড় অনুষ্ঠান বলতে পহেলা বৈশাখেই হয়। এতেই খুব বেশি চাপ পড়ে কি ?
সিএমপি কমিশনার বলেন, আয়োজন যত দীর্ঘায়িত হয়, ঝুঁকি তত বাড়ে। যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী, তাদের নিরাপত্তারও তো একটা বিষয় আছে। আসুন, আমরা এ বিষয়টা নিয়ে আর বিতর্ক না করি। পহেলা বৈশাখের আয়োজন নিয়ে দৃশ্যমান কোনো ঝুঁকি নেই। তবে সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই আমাদের সতর্কতা এবং প্রস্তুতি আছে।
