
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ডিসি পার্কেতৃতীয়বারের মতো ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। পার্কটিতে এখন সৌরভ ছড়াচ্ছে ১৩৬ প্রজাতির দুই লাখের অধিক বাহারি ফুল। শনিবার থেকে শুরু হওয়া মাসব্যাপী এ ফুল উৎসব চলবে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা।
এবারের ফুল উৎসবে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের জন্য রয়েছে ১৩৬ প্রজাতির লক্ষাধিক ফুলের সমারোহ এবং প্রতিদিন বিনোদনমূলক নানা মনোমুগ্ধকর আয়োজন। মাসব্যাপী আয়োজিত এ ফুল উৎসবের বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল, মাসব্যাপী গ্রামীণ মেলা, বই উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, ফুলের সাজে একদিন, পিঠা উৎসব, নৌকা বাইচ, লেজার লাইট শো, ভিআর গেম, মুভি শো, ভায়োলিন শো, পুতুল নাচ, পানিতে ভাসমাস ফুল বাগানসহ নানা রকমের আয়োজন। এছাড়া উৎসবে আসা দর্শনার্থীদের নিজেদের ছবির ক্যারিকেচার আঁকার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যা এখানে আসা প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ফুল পবিত্রতার প্রতীক, সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুল মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়, মানুষের মনে নির্মল আনন্দ নিয়ে আসে। ফুলের সমারোহে এসে মানুষ সব মন্দ কাজ ভুলে সমাজের ইতিবাচক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। সমাজের সকল ¯‘র থেকে নেতিবাচক মনোভাব দুর করে ফুল সমাজে ভালবাসার নতুন বারতা নিয়ে আসে।
সেই আকাঙ্খাকে সামনে রেখে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে সীতাকুণ্ড উপকূলে বেদখল হওয়া ১৯৪ একর জায়গা উদ্ধার করে জেলা প্রশাসন ৩য় বারের মতো চট্টগ্রাম ফুল উৎসব আয়োজন করেছে। আগে এ জায়গাটি মাদক সেবীদের আখড়া ছিলো। সে স্থানে এখন বসেছে ভালবাসার মিলনমেলা তথা ফুল উৎসব। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ-গাঁদা প্রভৃতি দেশী বিদেশী ১৩৬ প্রজাতির ফুলের পসরা বসেছে এ মেলায়। ফুলের সৌরভে চারদিক মাতোয়ারা। ফুলের সুবাসে সুবাসিত পুরো চট্টগ্রাম। এহেন নয়নাভিরাম ফুল উৎসব শুরু হয়েছে। শনিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রধান অ।তিথি হিসেবে থেকে ড. শেখ আব্দুর রশীদ এ উৎসব উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ফিতা কেটে, বেলুন ও শান্তির কপোত উড়িয়ে মাসব্যাপী চট্টগ্রাম ফুল উৎসবের উদ্বোধন করেন তিনি। উদ্বোধন শেষে প্রধান অতিথি অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে ভাসমান ফুল বাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের সমারোহ পরিদর্শন করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমরা যারা দায়িত্বশীল আছি এবং ভবিষ্যতে যারা দায়িত্ব গ্রহণ করবে সবার জীবনকে ফুলের মত পবিত্র করে গড়ে তুলতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, চট্টগ্রামের বড় ঐতিহ্য হচ্ছে মেজবান। এটা বছরের পর বছর ধরে চলছে বিধায় ঐতিহ্যতে রুপ নিয়েছে। একইভাবে যদি এ ফুল উৎসব টিকিয়ে রাখা যায় আগামীতে এটাও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যে রুপ নেবে। মানুষের মনের প্রশান্তি মেটাতে এ ধরনের উৎসবের প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের এ উদ্যোগ যখন দেশের সবাই জানতে পারবে তখন অন্যরাও ফুল উৎসব করার জন্য এগিয়ে আসবে এবং এটার জন্য সরকার সবোচ্ছ সহযোগিতা করবে।
তিনি আরো বলেন, ফুল আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফুল মনের জড়তা, সংকীর্ণতা দূর করে মানুষের মনকে নির্মল আনন্দ দেয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনে ফুল ব্যবহার হয়ে থাকে। আজকে ১৩৬ প্রজাতির প্রায় ১ লক্ষ ফুল দেখে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে গেছে। আগামী প্রজন্মের মনে ফুলের মাধুর্যকে ফুটিয়ে তুলতে এ ফুল উৎসব সহায়তা করবে।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার ড. মোঃ জিয়াউদ্দীন বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। স্থানীয় সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোঃ খোরশেদ আলম খান, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ নুরুল্লাহ নুরী, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থী, সুধীজন ও স্থানীয় শিল্পী, কলকৌশলী, অসংখ্য দর্শণার্থীসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের পরিবেশনায় দলীয় নৃত্য, সঙ্গীত, দ্বৈতসঙ্গীত ও পাপেট শো পরিবেশিত হয়।
সভাপতির বকএব্য জেলা প্রশাসক বলেন, আপনার সবাই জানেন ফুল পবিত্রতার প্রতীক। আমরা মানুষকে যখন আর্শীবাদ জানাই তখন বলি, তোমার জীবন ফুলের মত সুন্দর হোক। তাইতো ফুল উৎসব। আগে এ জায়গাটা মাদকের অভয়ারণ্য ছিল। দখলদার ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ১৯৪ একর জায়গাকে উদ্ধার করে ফুলের পবিত্র ভূমিতে উন্নীত করতে পেরে আনন্দ অনুভব করছি। এ ফুল উৎসবকে শুধু মাসব্যাপী না করে সারাবছর যাতে করা যায় এবিষয় নিয়ে আমাদের চিন্তা রয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৪ একর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা ডিসি পার্কে তিনটি বিশাল আয়তনের পুকুর রয়েছে। আরও রয়েছে ফুডকোর্ট, পর্যটকদের বসার স্থান, সেলফি কর্নার, অনুষ্ঠানস্থল, ভাসমান ফুল বাগান, হাটা চলার উন্মুক্ত স্থান, অস্থায়ী খেলার মাঠ, স্থায়ী ফুলের বাগান, শিশুদের খেলার মাঠ, ভিআইপি জোন, কন্ট্রোল রুম, রেস্টুরেন্ট, ফুড কর্নার, সানসেড ভিউ পয়েন্ট, টিউলিপ গার্ডেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান কর্নার ও পাবলিক টয়লেট।
সরেজমিনে ফুল উৎসবকে ঘিরে নতুন করে সাজিয়ে তোলা ডিসি পার্কে গিয়ে দেখা যায়, পুরো পার্কটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। তোরণ থেকে শুরু করে পানির ঢেউয়ের মাঝেও হাসছে নানান প্রজাতির ফুল। প্রতিটি মোড়েই হাওয়ায় দুলছে রঙিন ফুলগুলো। যা দেখে ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তোলার শখ এড়াতে পারছেন না ছেলে-বুড়ো কেউই।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলাউদ্দিন বলেন, ডিসি স্যারের নির্দেশনা মেনে পার্কটিতে মনের মতো করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। আশা করছি প্রতিদিন উপচে পড়া ভিড় থাকবে সেখানে। তিনি আরো বলেন, এখানে আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য বেশ কিছু খাবারের দোকান, নানান স্টল, পর্যাপ্ত টয়লেট থেকে শুরু করে সবই নির্মাণ করা হয়েছে।
সীতাকুণ্ডের ইউএনও কে এম রফিকুল ইসলাম জানান, ফুল উৎসবকে নতুন করে ভিন্নমাত্রায় সাজিয়ে তুলতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত কয়েকমাস ধরে টানা কাজ করছিলেন এক ঝাঁক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এবারের মেলার মঞ্চ করা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের আদলে। মেলার গেট থেকে শুরু করে ভেতরে উপরে নিচে যেদিকেই চোখ পড়বে শুধু ফুল আর ফুল। দর্শনার্থীদের বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে এখানে। তিনি আশা করছেন এখানে আসা প্রতিটি দর্শনার্থী বেশ উপভোগ করবেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বলেন, দেশে এরকম ফুল উৎসব হচ্ছে শুধুমাত্র ডিসি পার্কেই। চট্টগ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য এত সুন্দর স্পট আর নেই। তাই গতবছর এখানে লাখ লাখ মানুষের আগমন হয়েছে। দর্শনার্থীদের বিনোদনের কথা মাথায় রেখে পার্কে লক্ষাধিক ফুলের পাশাপাশি দুটি বিশাল দিঘিতে নানান রকমের রাইড, ভাসমান ফুল বাগান থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছুই করা হয়েছে তাতে যেকোন দর্শনার্থীর মন মুগ্ধ হবেই।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা আরো জানান, জুলাই বিপ্লবের নানান চিত্রও তুলে ধরা হবে এবারের মেলার স্টলে। সব মিলিয়ে ফুল উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখা হয়নি।