
চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানাধীন আবেদীন কলোনির বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন দিলরুবা বেগম পীপা (৩৫)। গত ২৭ অক্টোবর থেকে টানা তিন দিনেও খোঁজ না পেয়ে গত ৩০ অক্টোবর সিএমপির কোতোয়ালী থানায় নিখোঁজ ডায়েরি (জিডি) করেন স্বামী আবদুল আলীম প্রকাশ আলম (৪০)। তাঁর পরের দিনেই ৩১ অক্টোবর কর্ণফুলীর শিকলবাহা কালারপোল খাল থেকে গৃহবধূ পীপার মরদেহ উদ্ধার করলেন পুলিশ। তবে ১ নভেম্বর
বিকেলে ভিকটিমের ভাই সেলিম উল্লাহ বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যে মামলায় পীপার স্বামী ব্যবসায়ী আলমকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। নেওয়া হয় দুই দিনের রিমান্ডেও। তবে সন্তোষজনক কোন তথ্য মিলেনি।
এদিকে পীপার এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে ঘিরে নানা রহস্যের দানা বাঁধতে শুরু করে চারদিকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি বন্দর জোনের ডিসি, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মুকুর চাকমা, বন্দর জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার (এসি) অতিরিক্ত দায়িত্বে কর্ণফুলী মাহমুদুল হাসান, কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ মনির হোসেন, এসআই মোবারক হোসেন, এসআই মিজানুর রহমান, এসআই আজিজুর রহমানের চৌকস টিম।
খালে ভাসমান লাশ পাওয়ার খবরে এরই মধ্যে ঘটনার ছায়া তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে সিএমপি’র বন্দর বিভাগের কর্ণফুলী থানা পুলিশের চুলচেরা বিশ্লেষণ আর রুদ্ধদ্বার টানা ৭ দিনের তদন্তে অবশেষে ক্লুলেস এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার জট খুলে রহস্য উদ্ঘাটন করেন।
থানা পুলিশ ও মামলা সূত্রে জানা যায়, শুরুতে খালে লাশ পাবার পর প্রশ্ন ছিলো এটি হত্যা, না আত্মহত্যা! ঘটনার পরপরেই ভিকটিমের ভাইয়ের করা হত্যা মামলা। স্বামী গ্রেফতার। মোবাইল ফোনের হদিস না পাওয়া। খালে গলিত লাশ। কাপড়, ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা না পাওয়া। সব কিছু মিলিয়ে মরদেহ উদ্ধারের পর এটি আত্মহত্যা ছিলো? নাকি পরিকল্পিত খুন-এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলো না পুলিশ।
বিশেষ করে এই মামলার তদন্তে মোড়ে মোড়ে নানা রহস্য ভেদ করে সত্য উদঘাটনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন সিএমপি বন্দর বিভাগের এডিসি-এসি। তাঁরা হত্যা মামলাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখে প্রথমে এগিয়ে যেতে থাকেন। ঘটনায় বের হওয়া নানা শাখা প্রশাখা ভেদ করতে থাকেন।
যদিও থানায় পীপা হত্যা মামলা হওয়ার পরে ভিকটিমের পরিবার ও স্বামী পক্ষের লোকজনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে আরও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিলো মামলায়। লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে তখনো পুলিশ বলছিলেন, লাশের ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে মৃত্যু রহস্য। কারণ এছাড়া কোন প্রমাণ তখনো পুলিশের হাতে আসেনি।
এতে এক পাশে ছিলো স্বামীর অন্তঃসারশূণ্য জবানবন্দি, গৃহবধূ পীপার কাছের বান্ধবীর বয়ান, সংসারে পারিবারিক কলহ, সুরতহাল রিপোর্ট, বাসার সিসিটিভি ফুটেজ, নতুনব্রিজ বাকলিয়ার গোল চত্বরের ভিডিও চিত্র ও ঘটনার দিন পীপাকে নিয়ে বের হওয়া সিএনজি চালক মোশাররফের দেওয়া তথ্যকে পুঁজি করে আবারো এগোতে থাকে পুলিশ।
জানা গেছে, নগরীর পুর্ব বাকলিয়া ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আব্দুল লতিফ হাট আব্দুল্লাহ সওদাগর বাড়ির হাজী মো. মহসিনের মেয়ে দিলরুবা বেগম পীপার সাথে ২০১০ সালে আবদুল আলিম প্রকাশ আলমের বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে দুটি সন্তান রয়েছে। আরশী আকতার (১৩) ও আজুয়া (৯)।
এদিকে তদন্তের প্রথম দিনেই পুলিশ সিসিটিভি’র ফুটেজে দেখেন, পীপা গত ২৭ অক্টোবর রাত ৭টা ২৪ মিনিটের সময় নগরীর আবেদীন কলোনির বাসা থেকে বের হন। তারপর সে সিএনজি নিয়ে রাত ৮ টা ৬ মিনিটের সময় বাকলিয়া পৌঁছান।
তাঁর মানে বাসা থেকে সে বের হবার ঠিক ৪২ মিনিট পর সে শাহ আমানত সেতুতে (নতুনব্রিজ) পৌঁছেন। সেখানে তার ফোন এক্টিভ ছিলো ৮ টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত। অবশ্য ফোন লাইনে (রানিং) কারো সাথে সর্বশেষ কথা বলছিলেন। এ সময় ফোনের লোকেশন কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা, মইজ্জ্যারটেক মর্ডান পলি ও বাকলিয়া চর চাক্তাই দেখা যায়। এরপর ফোন আর এক্টিভ হয়নি। তবে শেষ কলে পীপা ৮ মিনিট ২৫ সেকেন্ড মতো কথা বলেন।
পরে থানা পুলিশের অনুসন্ধানী তদন্তে জানতে পারেন সর্বশেষ কথা বলা ব্যক্তির ফোন নম্বরটি ছিলো ভিকটিমের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করা ই-সিম। পরে সিমটি আবার আন-ইন্সটল। এমন তথ্য সামনে আসলে পুলিশ বিভ্রন্তিতে পড়েন। এরমধ্যে সিএনজি চালক মোশাররফ জানান, তিনি ভিকটিমকে ঘটনার রাতেই সাড়ে ৮টার দিকে বাকলিয়া থানাধীন নতুনব্রিজ গোলচত্বরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছেন।
কিন্তু নতুনব্রিজ এলাকার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজে এ তথ্যের কোন সত্যতা পায়নি পুলিশ। এর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ বের করেন সর্বশেষ কার সাথে পীপা কথা বলেছিলেন। পরে টি আদ্যক্ষরের ওই ব্যবসায়ীকে আটক করে শুরু হয় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু তাঁর কাছ থেকেও এমন কোন তথ্য বের হয়নি। তাঁকে আটকানোর মতো। তবুও তাঁকে দু’দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাঁর দেওয়া তথ্যে কোন গড়মিল সামনে আসছে না। বরং পীপাকে খুঁজতে তিনিও বাকলিয়া, কর্ণফুলী ঘুরে চলে যান বলে সত্যতা মিলে। তবে সাক্ষাৎ হয়নি তাঁর সাথে পীপার।
তবুও থেমে নেই পুলিশ। আবারো সিএনজি চালকের গ্যারেজে তল্লাশি চালানো হয়। পীপার মোবাইল বা ভ্যানিটি ব্যাগের সন্ধান মিলে কিনা। পর্যবেক্ষণ করা হয় তাঁর গতিবিধি। রাত ৭টা ২৪ মিনিটের আগেও সিএনজি চালকের লোকেশন আবেদীন কলোনী। রাত ৯টা ৩৭ মিনিট পরও আবেদীন কলোনী। আর কোথাও লোকেশন নেই। অথচ ওর গাড়িতে করে বাকলিয়া আসেন গৃহবধূ পীপা। কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
টানা ৪-৫ দিনের তদন্তে কোন কূল কিনারা নেই মামলায়। একজনের তথ্যের সাথে আরেক জনের তথ্যে কোথাও মেলবন্ধন নেই। এর মধ্যে পুলিশ একাধিক জনকে গোপনে ও প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কিন্তু কেমন জানি গড়মিল পাচ্ছিলো থানা পুলিশ। কারণ পীপা যদি ঘটনার দিন রাতে নতুনব্রিজের গোলচত্বরে সিএনজি থেকে নামতেন। তাহলে ১০ টার অধিক আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়তো সে দৃশ্য। কিন্তু তাঁকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। এমন কি গোলচত্বর থেকে যাওয়া বিভিন্ন শাখা সড়ক ও অলিগলির ক্যামেরাও চেক করা হয়। কিন্তু কোথাও পীপা নেই। কিভাবে নদীতে গেল তাঁর লাশ। শুরু আবারো অনুসন্ধান।
পরক্ষণেই বন্দর জোনের এডিসি মুকুর চাকমা ও এসি মাহমুদুল হাসান সিএনজি চালককে আবারো তলব করলেন। কারণ তাঁর কথার সাথে তথ্য মিলছে না। পরে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে এক সময় সিএনজি চালক পুরো ঘটনাটি পুলিশকে খুলে বলতে বাধ্য হন। সে প্রথমে মিথ্যা বলেছিলো। পীপাকে সে নতুনব্রিজ গোলচত্বরে নামায়নি বরং সে শাহ আমানত সেতু (নতুনব্রিজ) পার হয়ে মইজ্জ্যারটেক গোলচত্বর ঘুরে এসে সেতুর মাঝখানে এসে থামেন।
তারপর গাড়ি থেকে কথা বলতে বলতে সিএনজি থেকে তাৎক্ষণিক নেমে পীপা নদীতে লাফ দেয়। তখন মোবাইল ফোন পীপার হাতে ছিলো বলে চালকের দাবি। ভ্যানিটি ব্যাগটি গাড়িতে ছিলো। যা বলে যায় চালক মোশাররফকে। পরে ভয়ে চালক এ কথা কাউকে জানায়নি আর। ভ্যানিটি ব্যাগটি দুইদিন পর সে নিমতলা খালে ফেলে দেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেন।
এমনকি পাশের একটি নদীপাড়ের জেটিঘাটে সিসিটিভি’র ভিডিও ফুটেজে তা ধারণও হয়। পীপার লাফ দিয়ে নদীতে পড়ার দৃশ্য। অথচ কি অদ্ভুত পীপা পানিতে পড়ার সাথে সাথে কম হলেও ৩০ ফুট উচ্চতায় পানির ছিঁটকাও দৃশ্যমান। কিন্তু নিচে থাকা ট্রলার, সাম্পান-নৌকা কিংবা ব্রিজে থাকা লোকজন কোন চিৎকার করলো না। কেউ এ বিষয়ে পুলিশকে খবরটি দেয়নি। এ জন্য বেশ বেগ পেতে হয়েছে থানা পুলিশকে।
কিন্তু এ ঘটনার ৫ দিন পর গৃহবধূ পীপার লাশ মিলে কালারপোল খালে। তখন ছিলো না মাথার চুল ও পরিধেয় বস্ত্র। এ প্রশ্নের উত্তরে তথ্য প্রযুক্তি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধারণাগত ভাবে জানান, কর্ণফুলী প্রবল স্রোতের নদী। সেতুর নিচেই স্রোতের চাপ থাকে তীব্রতা। কোন মানব শরীর দীর্ঘ সময় ধরে পানির ভেতরে থাকলে শরীরে পঁচন ধরে ফুলে পরিধেয় বস্ত্র খুলে বা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে যদি স্রোত বেশি থাকে বা কাপড়ের মান দুর্বল হয়। আবার প্রবল স্রোতে অন্যান্য বস্তুর সাথে চুল লেগে তা খসে যেতে পারে।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার এসআই মোবারক হোসেন ও এসআই মিজানুর রহমান বলেন, আমরা জাস্ট ডিসি স্যারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এডিসি ও এসি স্যারের দিক-নির্দেশনায় ওসি স্যারের নেতৃত্বে টিম ওয়ার্ক হিসেবে কাজ করেছি। এর বাহিরে কিছু না। এতেই হয়তো মামলায় সফলতা এসেছে।
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, সিএনজি চালক মোশাররফ আদালতে স্বাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। বাকিটা পরে জানাতে পারব।
সিএমপি বন্দর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা বলেন, থানা পুলিশের টানা ৭ দিনের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গৃহবধূ পীপা শাহ আমানত সেতু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যার ভিডিও ফুটেজও প্রমাণ মিলেছে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যার সত্যতা নিশ্চিত করে আদালতে স্বাক্ষীও দিয়েছেন সিএনজি চালক মোরশেদ আলম প্রকাশ মোশাররফ (৪৮)। বাকি তথ্য পরে জানাতে পারব।
