আজঃ শনিবার ৮ নভেম্বর, ২০২৫

আজকের দিনটি অনেক গর্বের ও আনন্দের দিন বলে উল্লেখ করলেন: প্রধানমন্ত্রী।

ঢাকা অফিস:

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হস্তান্তরের দিনটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গর্বের এবং আনন্দের দিন বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সফল পরিণতি লাভ করছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি শান্তি রক্ষায় ব্যবহার করবে।

বৃহস্পতিবার বিকালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা হস্তান্তর করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে।

ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হওয়ার দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা,

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ বীর শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে স্মরণ করে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সালাম জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি কৃতজ্ঞতা জানান বন্ধুপ্রতিম রাশান ফেডারেশনের সরকার এবং জনগণের প্রতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬-৫৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রী থাকাকালে এ অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্পায়নের উপর জোর দিয়ে নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন।

“১৯৬১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি এবং পূর্ববাংলার রূপপুরে একটিসহ মোট দু’টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ৭০ সাল পর্যন্ত নামমাত্র জমি অধিগ্রহণ ছাড়া সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তারা কিছুই করেনি।”

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সমুদ্র সম্পদ এমনকি খনিজ সম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন এবং বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে আমাদের গ্যাস ফিল্ডগুলো কিনে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।”

বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “সে অনুযায়ী কিছু কাজও হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর এই মেগা প্রকল্পটিসহ সকল জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে যায়।

১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট ও পলিসি স্টেটমেন্ট অন পাওয়ার সেক্টর রিফর্মস’ প্রণয়ন ও অনুমোদন করার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করি। ‘বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান-২০০০’ প্রণয়ন করি। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা- আইএইএর সহযোগিতা চাই।

“বিষয়টি যেহেতু আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ছিল, সে কারণে জটিল আইন-কানুন তৈরি করতেই আমাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেওয়া সকল জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি-প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। আবারও হিংসা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, বেপরোয়া লুটপাট এবং সেনা শাসনের পুরু আবরণে গণতন্ত্র ঢাকা পড়ে। তবে ২০০৮ সাল থেকে পরপর ৩ দফা সরকারে থাকার কারণেই আমরা আজ বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি।”

‘রূপকল্প ২০২১’ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১০’ প্রণয়ন করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আবার রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। তাছাড়া, আইএইএ শুরু থেকেই আমাদের নানাভাবে সহায়তা করে আসছে।”

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখন পর্যন্ত আপনার সর্বাত্মক সহযোগিতায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।”

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে জ্বালানি সংযুক্ত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “পরমাণু শক্তি আমরা শান্তি রক্ষায় ব্যবহার করব। আমরা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের সাধারণ ও সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তির বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আমরা ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করেছি এবং একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি।”

যেকোনো দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকটা খেয়াল রেখে এই প্ল্যান্টের ডিজাইন প্রণয়ন এবং নির্মাণকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “ব্যবহৃত জ্বালানি ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা রাশান ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। রাশান ফেডারেশন এসব স্পেন্ট ফুয়েল তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে।”

অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো. আলী হোসেন ও আরএনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শৌকত আকবর উপস্থিত ছিলেন।

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার। দুটি ইউনিটে বিভক্ত এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ ৭০ শতাংশ এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে দেশে আসে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পরদিনই তা প্রকল্প এলাকায় নেওয়া হয়।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে।

শেয়ার করুন-

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

আরও খবর

ঐক্যমতের বাইরে কথা বললে বিভেদ বাড়বে: আমীর খসরু


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন- দীর্ঘ আলোচনার পর যে ঐক্যমতে পৌঁছানো হয়েছে, সেটি আমাদের মেনে নিতে হবে। ঐক্যমতের বাইরে গিয়ে কথা বললে রাজনীতি ও সমাজে বিভেদ বাড়বে, যা গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।


শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের নবনির্মিত ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।


আমীর খসরু বলেন, আজ একটি ঐক্যমতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে। এটি গণতন্ত্রকে যেমন এগিয়ে নেয়, তেমনি সমাজকেও সামনে নিয়ে যায়। আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। সংলাপের মাধ্যমে সেই ভাঙন কাটিয়ে উঠতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সংলাপ করবো, ঐক্যমতে পৌঁছব, যতটুকু সম্ভব। যেটুকু ঐক্যমতে পৌঁছানো যাবে না, সেটি সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিতে হবে। নতুন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, কোনো সরকার একা নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারে না। এজন্য সবার অংশগ্রহণ ও দায়বদ্ধতা জরুরি। প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেই দেশ এগিয়ে যাবে।


বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছিলেন এমন একজন দূরদর্শী মানুষ, যিনি দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে বিশ্বাস করতেন, একদিন এই দেশ স্বাধীন হবে। আজ আমরা সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরে গর্বিত।


তিনি আরও বলেন, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনা এই আদর্শের ভিত্তিতেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। এখন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, আমাদের দেশে একটি অদ্ভুত বিভাজন আছে, ঢাকা থেকে পত্রিকা বের হলে সেটি ‘জাতীয় পত্রিকা’, আর ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত হলে ‘মফস্বল পত্রিকা’। আমার কাছে এটি একটি বৈষম্যমূলক ধারণা।

তিনি আরও বলেন, অনেকে বলেন, আজাদী যদি ঢাকায় গিয়ে প্রকাশ হয়, তাহলে জাতীয় পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু আমার বাবা দৈনিক আজাদী বের করেছিলেন চট্টগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সমস্যার কথা সরকারের সামনে তুলে ধরার জন্য, ঢাকায় বসে জাতীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নয়। কারণ আমরা চট্টগ্রামের মানুষকে ভালোবাসি। এই
ভালোবাসার বন্ধন থেকেই আমরা চট্টগ্রামবাসীর পাশে থাকতে চাই।


দৈনিক আজাদীর অর্থায়নে ও পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে মিলনায়তনটি সংস্কার ও ডিজাইন করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি। সঞ্চালনা করেন অন্তর্র্বতী কমিটির সদস্য গোলাম মওলা মুরাদ। অনুষ্ঠানে আরও বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন দৈনিক আজাদী পত্রিকার পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ) বাংলাদেশ চাপ্টারের চেয়ারম্যান ওসমান গণি মনসুর।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সদস্য মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত, দৈনিক আজাদীর নির্বাহী সম্পাদক শিহাব মালেক, প্রেসক্লাব অন্তর্র্বতী কমিটির সদস্য মুস্তফা নঈম, বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ান, সিএমইউজের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার, এ্যাবের সভাপতি জানে আলম সেলিম, বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি মিয়া মোহাম্মদ আরিফ।


অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন মোহাম্মদ হোসাইন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, রাজনীতিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় দাবিদাওয়ার ঝড়, কিন্তু নীরব প্রবাসীরা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের রাজপথ দাবিদাওয়ার ঝড়ে সরব। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক থেকে শ্রমিক—সবাই নিজ নিজ দাবি তুলে ধরছেন সরকারের কাছে।

তবে এই আন্দোলনের স্রোতের বাইরে রয়েছেন দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী—প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়েও তারা এখন পর্যন্ত কোনো দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেননি, কিংবা বিদেশে থেকেও কোনো সংগঠিত প্রতিবাদ জানাননি।

দেশে প্রতিদিনই নতুন নতুন দাবির ব্যানারে মিছিল-মিটিং দেখা যাচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবীরা বেতন সমন্বয়ের দাবি তুলেছেন। শিক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার স্বচ্ছতা চাচ্ছেন। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষকরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু প্রবাসীদের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া নেই। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, কিংবা পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে দাবি আদায়ের আন্দোলন বা সংগঠিত বক্তব্য এখনও অনুপস্থিত।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই নীরবতার পেছনে রয়েছে একাধিক বাস্তব কারণ।

১. ভৌগোলিক দূরত্ব ও আইনি বাধা:
বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত শ্রমিক বা চাকরিজীবীরা স্থানীয় আইনের কারণে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন না।
২. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা:

অনেকে আশঙ্কা করেন, কোনো প্রকার রাজনৈতিক বক্তব্য বা প্রতিবাদ তাদের চাকরি বা ভিসার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৩. সংগঠনের সীমাবদ্ধতা: যেসব প্রবাসী সংগঠন আছে, তাদের বেশিরভাগই সামাজিক বা কল্যাণমূলক কাজে সীমাবদ্ধ—দাবি আদায়ে তাদের ভূমিকা দুর্বল।

৪. দেশীয় রাজনীতিতে আস্থাহীনতা: প্রবাসীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, সরকার বদলায় কিন্তু নীতি বদলায় না—তাই আন্দোলনে অংশ নেওয়াকে তারা সময়ের অপচয় ভাবেন।

তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিমান টিকিটের মূল্যহ্রাস, রেমিট্যান্স পাঠানোর পদ্ধতি নিরাপদ ও সহজিকরণ, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সেবার মানোন্নয়ন, দেশে বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে কর-ছাড় ও প্রণোদনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের কার্যকর ব্যবস্থা, বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা ও পেনশন সুবিধার আওতায় আনা, দেশে প্রবাসী ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তায় বিশেষ আইনের ব্যবস্থা করা এবং এয়ারপোর্টে হয়রানি বন্ধ সহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছেন। তবে এসব এখনো আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ; কোনো বাস্তব রূপ নেয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বায়িত্ব নেয়ার পর একজন উপদেষ্টা বলেন, “প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির প্রাণ। তাদের সমস্যা ও দাবি নিয়ে আলাদা একটি টাস্কফোর্স গঠনের চিন্তা চলছে। তবে প্রবাসী সমাজ মনে করে, আগেও অনেক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্সই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে টিকিয়ে রেখেছে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীরা যদি সংগঠিতভাবে তাদের নীতিগত দাবি তুলে ধরতে পারতেন, তবে শুধু তাদের কল্যাণ নয়, দেশের অর্থনীতিও আরও সুসংহত হতে পারত। দেশের রাজনীতিতে যখন নতুন রূপান্তরের সময় চলছে, তখন প্রবাসী সমাজের এই নীরবতাই একদিন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তারা হয়তো এখন আন্দোলনে নেই, কিন্তু তাদের রেমিট্যান্সই প্রতিদিন দেশের চাকা ঘোরাচ্ছে—নীরবে, নিয়মিতভাবে, অবিরাম। এটা ভূলে গেলে চলবেনা। প্রবাসীদের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিৎ।

আলোচিত খবর

আরব আমিরাতে ভিসা সংকটে বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশি শ্রমবাজার।

মধ্যপ্রাচ্যের  অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা জটিলতায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। নতুন ভিসা ইস্যু বন্ধ থাকা এবং অভ্যন্তরীণ ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও কবে ভিসা উন্মুক্ত হবে— সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারছে না বাংলাদেশ মিশন। বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আমিরাত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভিসা জটিলতা শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাব পড়ছে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধভাবে বসবাস, লিঙ্গ পরিবর্তন, সনদ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ ওঠায় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি করেছে আমিরাত সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশিরা।

এদিকে দুবাইয়ে স্কিল ভিসা চালু থাকলেও সেখানেও কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন সনদ ছাড়া বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সনদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন, পরে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের যাচাই এবং শেষে আমিরাতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। দীর্ঘ ও জটিল এ প্রক্রিয়ায় হতাশ কর্মপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ মিশনের তথ্যানুসারে, স্কিল ভিসায় সনদ জালিয়াতি ঠেকাতে তিন মাস আগে চালু করা হয়েছিল বারকোড ব্যবস্থা। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটিও জাল করে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ইউএই সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশিদের মানসিকতা না বদলালে ভিসা সংকট নিরসন সম্ভব নয়।

আবুধাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ বলেন, “গত সাত মাস ধরে ভিসা ইস্যুতে চেষ্টা চালিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।কবে হবে সেটিও অনিশ্চিত। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, তবে বিষয়টি পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ”

 

জনশক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা পরিবর্তনের জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে। অনেকেই জানেন না, ভিসা বাতিল হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যারা আমিরাতে অবস্থান করছেন, তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশি প্রবাসী সংগঠকরা মনে করেন, এ অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রবাসীদেরও ভিসা নীতিমালা মেনে চলা জরুরি। নইলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজারে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ