
অবশেষে চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া আলোচিত জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক। শ্বাসরুদ্ধকর ৬৪ দিনের যাত্রা শেষ করে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) এক নম্বর জেটিতে নাবিকদের বহন করা জাহাজ এমভি জাহান মনি-৩ কে ছোট ছোট তিনটি টাগবোট পাহারা দিয়ে জেটিতে নিয়ে আসে। জাহাজটি জেটিতে ভিড়লে সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুপুর ২টার দিকে কুতুবদিয়া উপকূল থেকে তাদের নিয়ে রওনা দিয়েছিল জাহাজটি।
এদিকে এনসিটি-১ জেটিতে আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন নাবিকদের স্বজনরা। জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাতসহ কর্মকর্তারা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা মুক্ত নাবিকদের বরণে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন।
জাহাজ থেকে জেটির কাছাকাছি দৃষ্টিসীমানায় আসার পর জেটিতে জড়ো হওয়া সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। জাহাজ থেকে নাবিকরা হাত নেড়ে উচ্ছ্বাসের জবাব দেন। এসময় নাবিক পরিবারের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এদিকে বন্দরের জেটিতে ২৩ নাবিককে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।

জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, একটা মাস কী যে টেনশনে ছিলাম, বোঝাতে পারব না। ছেলের জন্য রাতদিন নামাজ পড়েছি, খেতেও পারিনি। ঈদও ভালো করে কাটাতে পারিনি আমরা কেউ। ছেলেকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে। ছেলে বলে রেখেছে আমার হাতের রান্না খাবে জাহাজ থেকে নেমে। বাসায় ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি। বাসায় সবাই অপেক্ষা করে আছে। আমার আত্মীয়-স্বজনরাও এসেছে।
জানা গেছে, জিম্মিদশায় জাহাজটিতে নাবিকদের নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। খাবার ও পানির সংকটসহ নানা কষ্টে দিন পার করেছেন নাবিকেরা। নাবিকদের ফিরে পাওয়ার আশায় উদগ্রীব ছিলেন সবাই। শ্বাসরুদ্ধকর সময় পার করছিলেন তাদের পরিবার-পরিজন। অবশেষে নাবিকদের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হলো।
কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত সাংবাদিকদের বলেন, একমাস ধরে আমরা অনেক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছি। অবশেষে আমাদের ভাইয়েরা আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন। আমাদের নাবিকেরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী সবাই যে কোনো ধরনের সহযোগিতা আমাদের দিয়েছেন। প্রথম দু’সপ্তাহ আমাদের তীব্র উৎকণ্ঠা ছিল যে, আমাদের নাবিকদের ওপর কোনো ধরনের চাপ বা নির্যাতন করা হচ্ছে কি না। কিন্তু যখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, সেরকম কিছু হচ্ছে না, এরপর আমরা মূলত আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করে নাবিকদের জাহাজসহ মুক্ত করার ব্যবস্থা করি।
কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেন, আমাদের প্রথম দিন থেকেই উদ্দেশ্যে ছিল ২৩ জন নাবিককে সুস্থভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা। সেটি আমরা পেরেছি। শুধু এক নাবিকের স্কিন র্যাশ হয়েছে। সেটি তেমন কিছু না। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ এখনও কুতুবদিয়ায়। নাবিকরা এমভি জাহাজ মনি লাইটার জাহাজে করে ফিরেছে। কারণ আবদুল্লাহতে যে পণ্যগুলো আছে সেগুলো খালাস করতে দেরি হবে। নতুন নাবিকদের সেখানে পাঠিয়ে ওই ২৩ নাবিককে আপাতত নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা চেয়েছি তাদেরকে পরিবারের কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরত দেওয়া।
নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি ছিল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম নাবিকদের মুক্ত করতে তারা আমাদের কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। তারা যদি আমাদেরকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করতো তাহলে আমাদের কিছু করার ছিল না। আমাদের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতায় আমরা নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে বরণের পর নাবিকেরা ঘরে ফিরতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারা দেশে তাদের পাঠানোর ব্যবস্থাও কোম্পানির পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
জানা গেছে, সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে একমাস জিম্মি থাকার পর মুক্ত করা হয়েছিল এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ও এর ২৩ নাবিককে। মুক্তির একমাস পর গত সোমবার (১৩ মে) দুপুরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় কক্সবাজারে পৌঁছে জাহাজটি। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ সেটা কুতুবদিয়ায় পৌঁছে নোঙ্গর ফেলে। জাহাজটিতে নতুন নাবিক পাঠানো হয়েছে। লাইটারেজ জাহাজে চড়ে নতুন নাবিকদের একটি দল জাহাজটির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ওই ২৩ নাবিক।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ বেলা ১২টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়। জাহাজটি কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুরুদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ জানান, তারা বরাবরই আশাবাদী ছিলেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, কোনো রক্তের বিনিময়ে তারা জাহাজ ফেরত চান না। আলাপ-আালোচনা এবং দস্যুদের সন্তুষ্ট করেই তারা সবাইকে নিরাপদে দেশে ফেরাতে চান। অবশেষে বীমা কোম্পানিসহ মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় বিপুল অর্থের মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় নাবিকদের মুক্ত করা হয়। মুক্তিপণ পরিশোধের পর গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ৮ মিনিটে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার পরই জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত উপকূল থেকে সোমালিয়ার সীমানা পার করে দেয়। জাহাজটি ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে চারটায় আল হামরিয়া বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছে। পরদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নোঙ্গর করে জেটিতে। সেখানে ৫৫ হাজার মেট্রিকটন কয়লা খালাসের পর ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সেটি চুনাপাথর বোঝাই করার জন্য মিনা সাকার বন্দরে যায়। চুনাপাথর বোঝাই করে আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দর থেকে জ্বালানি নিয়ে ৩০ এপ্রিল জাহাজটি দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
