আজঃ শনিবার ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রাম থেকে ভারতে নারী পাচারের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত চক্রের সদস্য মো. তারেকক (৩৪)

সীমান্ত এলাকার ‘দালালে’র মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঘটায় চট্টগ্রামে ভারতে নারী পাচারকারী চক্র সক্রিয়

চট্টগ্রাম ব্যুরো:

: চট্টগ্রাম থেকে ভারতে নারী পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে ভারতের ঝাড়খণ্ডের একটি অপরাধী চক্রের যোগাযোগ থাকায় অতি সহজে নারীদের পাচার করে আসছে। বিশেষ করে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ভারতে ভালো বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত এলাকার ‘দালালে’র মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তবে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ এ চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতারের পাশাপাশি আরো কয়েকজনের তথ্য পেয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দুই তরুণীকে। এক তরুণী কৌশলে পালিয়ে দেশে চলে আসেন। তবে আরেকজন এখনো ‘নিখোঁজ’ আছেন। দেশে ফেরা তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে পাচারকারী চক্রটির সন্ধান পাওয়া গেছে। গত ২৩ জুন গভীর রাতে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার চন্দ্রনগর আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই চক্রের সদস্য মো. তারেককে (৩৪)। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নে। নগরীর চন্দ্রনগর আবাসিক এলাকায় দিদার ভবনে থাকেন তিনি।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা জানান, তারেক ছাড়াও চক্রের আরও তিন সদস্যের নাম-পরিচয় তারা জানতে পেরেছেন। তারা হলেন— ঝুমু, পারভিন আক্তার ও আনিছুর রহমান। এর মধ্যে ঝুমু সম্পর্কে তারেকের স্ত্রী।
পুলিশের তথ্য বলছে, এই চক্রের সঙ্গে ভারতের ঝাড়খণ্ডের একটি অপরাধী চক্রের যোগাযোগ আছে। এরা পরস্পরের যোগসাজশে সীমান্ত এলাকার ‘দালালে’র মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিভিন্ন বয়সী নারীদের অনুপ্রবেশ ঘটায়। এরপর ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন হোটেলে তাদের আটকে রেখে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে। তারেকসহ চক্রের সদস্যদের বৈধ-অবৈধপথে নিয়মিত ভারতে যাতায়াতের তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ওসি।
পুলিশ আরো জানায়, পাচারের শিকার তরুণী পূর্ব ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচি থেকে কোলকাতা হয়ে গত ৬ জুন দেশে পালিয়ে আসেন। এরপর ২৩ জুন তিনি চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও তিন-চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তরুণীর বাড়ি রংপুর জেলায়। পোশাক কারখানায় চাকরির সুবাদে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। পাশের মাইজপাড়া এলাকায় রয়েল অ্যাপারেলস নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। গত এপ্রিলে তিনি ও তার বান্ধবী চাকরি ছেড়ে দেন।
২০২১ সালে তারা হাটহাজারীর চৌধুরীহাটে গার্মেন্টস পার্ক নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। একই কারখানায় পারভিন আক্তার নামে এক নারীও কর্মরত ছিলেন। রয়েল অ্যাপারেলস থেকে চাকরি ছাড়ার পর নতুন কাজের খোঁজে পারভিন আক্তারের কাছে গিয়ে মূলত দুই তরুণী পাচারকারী চক্রের খপ্পড়ে পড়েন।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, গত ২০ মে পারভিন আক্তারের সঙ্গে নগরীর অক্সিজেন মোড়ে তারা দেখা করেন। পারভিন তাদের ভারতের রাঁচিতে পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেন। রাজি হলে পরদিন সকালে তাদের তারেকের বাসায় নিয়ে যান। তারেকের স্ত্রী ঝুমু তাদের জানান, ভারতে পার্লারে চাকরি করলে তারা মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবেন, তবে ভারতের যাওয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে হবে। ২৯ মে সন্ধ্যায় দুই বান্ধবীকে নিয়ে তারেক, ঝুমু ও পারভিন নগরীর দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে যশোরের পথে রওয়ানা দেন। পরদিন ভোরে তাদের যশোরে আনিছুর রহমানের বাসায় নেওয়া হয়। সেদিন রাতে তারা সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে একটি কলাবাগানের ভেতরে অবস্থান নেন। সেখান থেকে কখনো ভ্যানে, আবার কখনো পায়ে হেঁটে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পাড়ি দিয়ে ৩১ মে ভোরে ভারতে পৌঁছান। তাদের সঙ্গে ছিলেন ঝুমু ও পারভিন এবং ভারতের সীমান্ত এলাকার কয়েকজন দালাল।
ভারতের ভেতরে সীমান্তবর্তী এলাকায় এক দালালের বাসায় তারা আশ্রয় নেন। ৩১ মে ভোরে পারভিন এক তরুণীকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডের উদ্দেশে চলে যান। আরেক তরুণী, যিনি মামলার বাদী, তিনি ওই দালালের আশ্রয়ে তিন দিন ছিলেন। ২ জুন রাতে ঝুমু তাকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডে পৌঁছান। রাঁচিতে একই হোটেল দুই বান্ধবীকে রাখা হয়। শুরুতেই তারা জানতে পারেন, ওই হোটেলে পতিতাবৃত্তি হয়। তাদেরও মূলত এ কাজের জন্য সেখানে নেওয়া হয়েছে। দুজন কান্নাকাটি করতে থাকলে তাদের মারধর করা হয় এবং একপর্যায়ে আলাদা করে ফেলা হয়।
৩ জুন বিকেলে হোটেল থেকে পালিয়ে এক তরুণী রাঁচি থেকে ট্রেনে করে কোলকাতার হাওড়া স্টেশনে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি মোবাইলে তার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাওড়া স্টেশনে বিভিন্নজনের সহায়তায় ট্রেনে করে যশোর সীমান্তে যান। এরপর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ৬ জুন ভোরে তিনি দেশে পৌঁছান।
ওসি সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, দেশে ফিরে আসা তরুণী জানিয়েছেন, তাদের পাচারের পর রাঁচিতে মনীষা রায় নামে এক নারীর কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। ওই নারী তাদের হোটেলে রেখেছিল। খুব সম্ভবত পুলিশের অভিযানের মুখে অথবা বিপদের আঁচ করে মনীষাই আবার এক তরুণীকে কোলকাতার হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দেন। তার লোকজনই যশোর সীমান্তে এনে তাকে আবার বাংলাদেশে ফেরত আসতে সহায়তা করেন। আরেক তরুণীর বিষয়টি আমরা এখনো স্পষ্ট না।
মামলার বাদী জানিয়েছেন, ওই তরুণীকে আলাদা হোটেলে নেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে উনি পালিয়ে গেছেন। আদৌ এর সত্যতা কতটুকু, জানি না। তিনি কি ঝাড়খণ্ডের পুলিশ হেফাজতে আছেন, নাকি এখনো পাচারকারীর হাতে জিম্মি রয়েছেন, নাকি দেশে ফিরেছেন আমরা খতিয়ে দেখছি।
ওসি আরও বলেন, গ্রেফতার তারেকের কাছে তথ্য থাকতে পারে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তিনি জানান।

শেয়ার করুন-

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

আরও খবর

কুষ্টিয়ায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বয়স্ক নারীর লাশ উদ্ধার।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় হাত–পা বাঁধা অবস্থায় খাইরুন নেছা (৬০) নামের এক বয়স্ক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে উপজেলার রামচন্দ্রপুর মানিকের বাঁধ এলাকার পাশ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত নারী হলেন ঐ এলাকার মৃত রজব আলীর মেয়ে।

পুলিশ ও স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, সকালেই মানিকের বাঁধের পাশে পানিতে ভেসে থাকা একটি লাশ দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে তাঁরা পুলিশে খবর দিলে ভেড়ামারা থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

এ বিষয়ে ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, তাঁকে হত্যা করে হাত–পা বেঁধে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। তদন্তে যা বের হবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কুষ্টিয়ায় বাড়ি থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় সোহাগ হোসেন নামের এক রাজমিস্ত্রির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুটি পিস্তল ও একটি ওয়ান শুটারগান উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ওসমানপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওসমানপুর কলপাড়া গ্রামে এই অভিযান চালান সেনাসদস্যরা। আজ শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় খোকসা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোশাররফ হোসেন এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া সেনাক্যাম্পের রওশন আরা রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিটের একটি দল ওসমানপুর গ্রামের সোহাগ হোসেন নামের এক যুবকের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় বাড়ি তল্লাশি করে দুটি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান, গুলি, দেশীয় চাকু ও হাঁসুয়া পাওয়া যায়। তবে অভিযানে কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সোহাগ হোসেন পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তাঁর বাবার নাম আশরাফ হোসেন।

পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন বলেন, সেনাবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার করা অস্ত্র থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

আলোচিত খবর

আরব আমিরাতে ভিসা সংকটে বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশি শ্রমবাজার।

মধ্যপ্রাচ্যের  অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা জটিলতায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। নতুন ভিসা ইস্যু বন্ধ থাকা এবং অভ্যন্তরীণ ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও কবে ভিসা উন্মুক্ত হবে— সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারছে না বাংলাদেশ মিশন। বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আমিরাত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভিসা জটিলতা শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাব পড়ছে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধভাবে বসবাস, লিঙ্গ পরিবর্তন, সনদ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ ওঠায় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি করেছে আমিরাত সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশিরা।

এদিকে দুবাইয়ে স্কিল ভিসা চালু থাকলেও সেখানেও কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন সনদ ছাড়া বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সনদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন, পরে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের যাচাই এবং শেষে আমিরাতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। দীর্ঘ ও জটিল এ প্রক্রিয়ায় হতাশ কর্মপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ মিশনের তথ্যানুসারে, স্কিল ভিসায় সনদ জালিয়াতি ঠেকাতে তিন মাস আগে চালু করা হয়েছিল বারকোড ব্যবস্থা। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটিও জাল করে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ইউএই সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশিদের মানসিকতা না বদলালে ভিসা সংকট নিরসন সম্ভব নয়।

আবুধাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ বলেন, “গত সাত মাস ধরে ভিসা ইস্যুতে চেষ্টা চালিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।কবে হবে সেটিও অনিশ্চিত। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, তবে বিষয়টি পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ”

 

জনশক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা পরিবর্তনের জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে। অনেকেই জানেন না, ভিসা বাতিল হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যারা আমিরাতে অবস্থান করছেন, তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশি প্রবাসী সংগঠকরা মনে করেন, এ অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রবাসীদেরও ভিসা নীতিমালা মেনে চলা জরুরি। নইলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজারে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ