
চট্টগ্রাম মহানগরে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। গ্রাহকের আকর্ষণ বাড়াতে নানা ধরনের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল মিশিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা সরাসরি ভোক্তাদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অভিযানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এসব ভেজাল খাদ্যপণ্যের ভয়াবহ বিস্তার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এছাড়া বেকারি পণ্য ও মিষ্টান্নে ভেজাল উপাদান ব্যবহার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার নগরের লালদীঘির পাড় এলাকায়
ভেজালবিরোধী অভিযানে দুই রেস্টুরেন্টকে জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নেতৃত্ব দেন চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও অসাধু ব্যবসায়ীরা সামান্য মুনাফা লাাভের আশায় গ্রাহকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় নগরজুড়ে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৪০টি ও জেলা অফিস চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় ২৫টি অভিযান চালিয়েছে। বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে বেশি অনিয়ম পেয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গত জুলাই ও আগস্ট মাসে নগর ও জেলায় মিলিয়ে মোট ৫৯টি অভিযান চালায়। এসব অভিযানে ৭১টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একাধিক অভিযানে এমন অসংখ্য অনিয়ম ধরা পড়লেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসছে না। অভিযানের সময় জরিমানা দিয়ে ব্যবসায়ীরা আবারও পুরোনো নিয়মে ফিরে যাচ্ছেন। নগরবাসী ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সদস্যদের অভিযোগ- আইনের কঠোর প্রয়োগ ও নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ভেজাল খাদ্যের এই ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন প্রান্তের বেকারি ও মিষ্টির দোকানে ভেজালের ছড়াছড়ি। দুধ, ঘি, ময়দা ও মিষ্টিতে ব্যবহার করা হচ্ছে পঁচা ডিমসহ নিম্নমানের উপাদান, সঙ্গে থাকছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল। মিষ্টির আকর্ষণ বাড়াতে বিপজ্জনক রং ব্যবহার করা হচ্ছে- যা দীর্ঘমেয়াদে লিভার ও কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করছেন অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, শুধু বেকারি বা মিষ্টান্নেই নয়, শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অবস্থাও উদ্বেগজনক। রান্নাঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাদ্যদ্রব্যে তেলাপোকার অবাধ বিচরণ, খাদ্য প্রস্তুতকরণের স্থানে ইদুরের বাসা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার পাশাপাশি ফ্রিজে রাখা হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পলবণ, বাসি তেল ও মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল, রংসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপকরণ। আবার ফাঙ্গাস পড়া বা বাসি খাবার পুনরায় গরম করে ভোক্তাকে দেওয়া হচ্ছে। ভোক্তারা মনের অজান্তেই এসব খাবার গ্রহণ করছে- যা ধীরে ধীরে দেহে নানা রোগের কারণ হয়ে উঠছে। নগরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ভেজাল চিপসের কারখানা। যা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার ক্ষতি করছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টের অবস্থা ভয়াবহ। আমাদের অভিযান নিয়মিত চলছে। দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। তবে ব্যবসায়ীরা যদি দায়িত্বশীল না হন তাহলে কোনো কিছুই পরিবর্তন সম্ভব নয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির তালিকাভুক্ত ৩৫০টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তবে এর বাইরে ছোট-বড় মিলিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টর সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। সমিতিটির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও মহানগরের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ আবদুল হান্নান বাবু বলেন, অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা যেকোনো উপায়ে অর্থ জোগাড় করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নেমে পড়ছেন। তাদের কোনো অতীত অভিজ্ঞতা নেই। মুনাফাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। খাবারকে মুখরোচক, আকর্ষণীয় করে তুলতে তারা ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করছেন।
ভেজাল খাদ্য ও অস্বাস্থ্যকর খাবার দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের জটিল রোগসহ নানান শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, আমাদের খাবারে যেভাবে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে- এটা আসলেই একটা উদ্বেগের বিষয়। ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কার্যকরী উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। যদিও তাদের জনবলে ঘাটতি আছে। তবুও এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাদা নজর দিতে হবে। ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মানুষ এখন মুনাফাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ব্যবসার আড়ালে সেবামূলক কাজ করতে হয়- সেটাই ভুলে যাচ্ছে। খাদ্য ব্যবসায় ভেজাল দেওয়া বা মানহীন খাবার দেওয়া- একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা হয়নি। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তারা সমন্বয় করে কাজ করলে সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে মঙ্গলবার ভেজালবিরোধী অভিযানে নগরের দুই রেস্টুরেন্টকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভ্রাম্যমাণ আদালত। নগরের লালদীঘির পাড় এলাকায় এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন চসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা।অভিযানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হোটেলের খাবার রান্না, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, রং ও ফ্লেভার ব্যবহার এবং ফুটপাত দখল করে দোকানের পণ্য রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার বিষয়টি আমলে নেন ম্যাজিস্ট্রেট।
এসব অপরাধে জালালাবাদ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টকে ২০ হাজার টাকা ও কে সি দে রোডের ডেগচি বাড়ি রেস্টুরেন্টকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন চসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ আহমদ।













