
চট্টগ্রামের দশটি আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করলেও ৮টিতে অসন্তোষ এখন তীব্র। বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কর্মীদের মধ্যে বিভাজন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মীরা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ, মশাল মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। এ কারণে দলের কোন্দল এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে এদের বিপরীতে সুসংগঠিত হচ্ছে জামায়াত।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের সবগুলোতে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী। প্রার্থীরা এখন স্ব-স্ব নির্বাচনী এলাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সাংগঠনিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী মাঠে বিএনপির অসন্তোষ ও বিভক্তির মাঝে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে আগেভাগেই প্রচারে মাঠে নেমে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভা করছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছেন দলটির প্রার্থীসহ নেতাকর্মীরা। এমন কী চট্টগ্রামের প্রতিটি আসনে ভোটারদের মন জয় করতে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডও করছে জামায়াত।

চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে মাঠে প্রচার-প্রচারণায় থাকা জামায়াতের প্রার্থীরা হলেন- চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে এডভোকেট সাইফুর রহমান, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর আলাউদ্দিন শিকদার, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আনোয়ারুল আলম সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) অধ্যাপক আবদুল মালেক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) শাহজাহান মঞ্জুর, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) ডা. এটিএম রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) ডা. আবু নাসের, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) ডা. ফজলুল হক, চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী-পাহাড়তলী-হালিশহর) অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) শফিউল আলম, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ডা. ফরিদুল আলম, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) ডা. শাহাদাত হোসাইন, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নগর জামায়াতের সাবেক আমীর আলহাজ শাহজাহান চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা জহিরুল ইসলাম। এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ৩ নভেম্বর সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঘোষণা করা হয় দশটি আসনের।
কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর-খুলশী) ও চট্টগ্রাম- ৮ (চান্দগাঁও, বোয়ালখালী ও পাঁচলাইশ আংশিক) আসন দুটি ছাড়া অবশিষ্ট ৮টিতে বিএনপির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম-১০ আসনে মনোনয়ন পান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অপরদিকে চট্টগ্রাম- ৮ (চান্দগাঁও, বোয়ালখালী ও পাঁচলাইশ আংশিক) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আলহাজ এরশাদ উল্লাহ। বর্তমানে এসব আসনে বিএনপির মধ্যে কোনো ধরনের অসন্তোষ দেখা যায়নি।

অন্যদিকে, চট্টগ্রামে অসন্তোষ দেখা দেওয়া ৮টি আসন হচ্ছে- চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী ও বায়েজিদ), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া), চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)। বিএনপির বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ, প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে তৃণমূলকে গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্র। এ কারণে নির্বাচনী মাঠে এত অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনের কারণে কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। এ কারণে অবশিষ্ট আসনগুলোতে প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে সময় নিচ্ছে দলটি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রয়েছে ৬টি আসন।
আসনগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর, পতেঙ্গা, ডবলমুরিং, ইপিজেড ও সদরঘাট), চট্টগ্রাম- ১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) এবং চট্টগ্রাম- ১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া)। তবে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) আসনটি বিএনপির শরিক এলডিপি-কে ছেড়ে দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম-৪ আসনে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে প্রার্থী ঘোষণার পরদিনই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীর সমর্থকেরা। তারা সীতাকুণ্ডের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার ঘণ্টা অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এতে অংশ নেওয়ায় আসলামপন্থী স্থানীয় চার নেতাকে পরে বহিষ্কার করে দল। এরপর আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা গত ২১ ও ২২ নভেম্বর দুই দফা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ মানববন্ধন করেছেন।
একই চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনেও। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মশাল মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে দলের একাংশ। এমন কী চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার জামাল নিজামের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে গত ১৩ নভেম্বর লিখিত চিঠি দিয়েছেন ওই আসনের তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এরা হলেন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস ও কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া।একই দিন চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মো. নুরুল আমিন চেয়ারম্যানকে পুনর্বিবেচনার জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ১১ বিএনপি নেতা।
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী ও বায়েজিদ আংশিক) আসনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হককে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের দাবিতে গত ২১ নভেম্বর অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়ক অবরোধ করেছেন তার সমর্থকেরা। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপির একাংশের অসন্তোষ চলে আসছে বাঁশখালী, পটিয়া, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়া আসনেও।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বঞ্চিতদের এমন বিক্ষোভকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, একটি বড় দলে এ ধরনের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ খুব বেশি আসনে হবে না। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করছি।










