আজঃ শনিবার ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

অবসর কাটুক দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায়

লেখক: মো: ইয়াসির আরাফাত

সোশ্যাল শেয়ার কার্ড

এই কার্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

অবসর মানবজীবনের এক বহু আকাঙ্ক্ষিত পর্যায়কাল। আমাদের নিত্য দিনের ছুটে চলা যেন এই এক টুকরো অবসর প্রাপ্তির খোঁজে। কর্মব্যস্ত জীবনে আমরা দিনশেষে একটু প্রশান্তির আশায় থাকি, যখন ব্যস্ততার চাপে অবদমিত শখ ও সুপ্ত ইচ্ছাগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ আসে। অনেকেই অবসরে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান, কেউবা শখের কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। কিন্তু কেমন হতো যদি এই অবসর আমরা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য ও কৃষ্টির চর্চার মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতাম?

বাংলাদেশের সংস্কৃতি হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এখানে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস, জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান, লোকসংস্কৃতি, গান, নৃত্য, নাটক, সাহিত্য এবং আরও নানা ধরণের সাংস্কৃতিক উপাদান। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে, যা বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের আলাদা করে তুলে ধরে। এছাড়াও, বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য আমাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। তেমনি গ্রামবাংলার পালাগান, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, বাউলগান, গম্ভীরা, পুঁথি-পাঠ আমাদের লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ, বর্তমানের নগরায়নের প্রভাবে এবং প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের কারণে এগুলো দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।

অবসরে যদি আমরা মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য কোনো সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত না হই, তবে একাকীত্ব ও হীনম্মন্যতা আমাদের গ্রাস করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অবসর সময়ে কোনো সৃজনশীল কাজ বা সাংস্কৃতিক চর্চা না করলে বিষণ্নতা ও অবসাদ দেখা দিতে পারে। তাই অবসর সময়ে দেশীয় সাহিত্য, সংগীত, নাটক, লোকসংস্কৃতি চর্চা করলে মনের খোরাক যেমন মিটে, তেমনি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যও টিকে থাকে। বর্তমানে, বিশ্বায়নের কারণে দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ওপর বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নগরায়ন, প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এবং আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। এক সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি অঞ্চলে লোকগানের আসর বসত, পুঁথি পাঠের প্রচলন ছিল, এবং মঞ্চ নাটকের জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। কিন্তু, এখন এসব ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল বিনোদনের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে, অবসর সময়ে দেশীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চা একদিকে আমাদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বাড়াবে, অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করবে। দেশীয় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের বই পড়া, নিজে কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ লেখা এবং সাহিত্য আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। সঙ্গীত ও নৃত্য চর্চায় বাউল, ভাটিয়ালি, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, জারি-সারি ইত্যাদির চর্চা করা এবং লোকনৃত্য শেখা ও শেখানো যেতে পারে। স্থানীয় নাট্যদল গঠন করা, মঞ্চনাটক মঞ্চায়ন করা এবং লোকনাট্যের চর্চার মাধ্যমেও দেশীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তাছাড়া, গ্রামীণ হস্তশিল্প, নকশি কাঁথা, মৃৎশিল্প, শোলাশিল্প ইত্যাদির চর্চা করে এগুলোর প্রচার ও প্রসার ঘটানো যেতে পারে। প্রবীণদের কাছ থেকে গ্রামীণ গল্প ও ঐতিহাসিক কাহিনি সংগ্রহ করে তা লিখে রাখা ও প্রচার করা গেলে সেটি হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।

উপরন্তু, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও সংরক্ষণ সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য সহজলভ্য করা যেতে পারে। সাথে সাথে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লোকসংস্কৃতিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশীয় হস্তশিল্প ও কারুশিল্প আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে দেশীয় সংস্কৃতির মিলবন্ধন ঘটালে এটি টিকে থাকবে, বিকশিত হবে এবং বিশ্ব দরবারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। এভাবে, আমরা একই সাথে আধুনিক প্রযুক্তি ও ধারার সংস্পর্শে থেকে আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সকল সংস্কৃতি ও কৃষ্টি পুনরুজ্জীবিত করতে পারি।

দেশীয় সংস্কৃতি আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। একে অবহেলা করা মানেই আমাদের শিকড়কে দুর্বল করে ফেলা। তাই অবসর সময়কে কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং মননশীল ও সৃজনশীল কাজের জন্য ব্যয় করা উচিত। দেশীয় সাহিত্য, সংগীত, নাটক, লোকসংস্কৃতি ও কৃষ্টির চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে পারি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ভান্ডার রেখে যেতে পারি। তাই আমাদের উচিত অবসর সময়কে মূল্যবান করে তোলা, যেন আমরা আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের গৌরব ধরে রাখতে পারি।

শেয়ার করুন-

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

আরও খবর

সাঘাটা হানাদারমুক্ত দিবস পালন: বীরত্বের ইতিহাসে উচ্ছ্বাসমুখর মানবসমাগম

সোশ্যাল শেয়ার কার্ড

এই কার্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা হানাদারমুক্ত দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় সাঘাটা। দিবসটিকে স্মরণীয় রাখতে সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।দিনটি উপলক্ষে সকালে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি উপজেলা চত্বর থেকে বের হয়ে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। র‌্যালিতে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

পরে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশরাফুল কবীর। সভায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য এবং স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন যুদ্ধকালীন রুস্তম কোম্পানির ১১ নং সেক্টরের সরকারি কোম্পানি কমান্ডার গৌতম চন্দ্র মোদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর সিদ্দিক, সাঘাটা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলহাজ্ব মোহাম্মদ আলী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল মঈন প্রধান লাবু, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা ইব্রাহিম হোসেন, সাংগঠনিক সেক্রেটারি এনামুল হক সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মতলুবর রহমান রেজা, আশরাফুল আলম, যুবদলের আহ্বায়ক আহমেদ কবীর শাহীন এবং বোনারপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জসিউল করিম পলাশ প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, ৮ ডিসেম্বর সাঘাটা হানাদারমুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ গণহত্যা ও নির্যাতন থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা নতুন প্রজন্মের মাঝে পৌঁছে দিতে এ ধরনের আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।অনুষ্ঠানের শেষে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করা হয়।

চুয়ান্নটি বছর

সোশ্যাল শেয়ার কার্ড

এই কার্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

স্বাধীনতার চুয়ান্নটি বছর চলেছে একই নীতিতে!
সত্যিই এবার পরিবর্তন প্রয়োজন।
স্বপ্ন আর আশা,
এই নিয়ে দেশের মানুষের বেঁচে থাকা।

কেহ দেশের শান্তি ফেরাতে দিয়েছেন প্রাণ,
কেহ আবার সব ভুলে গিয়ে নিজের সুবিধা আর আসন পাওয়া নিয়ে ব্যস্ততা,
আর এক শ্রেণীর মানুষের নেই ঘুম!

সুন্দর স্বপ্নময় দেশ গড়তে,
সর্ব প্রথম আইন,
বিচার ব্যবস্থা আর প্রশাসনের সঠিক উন্নয়ন প্রয়োজন। এই তিনটি যেন কারো ব্যক্তিগত কারো সম্পত্তি না হয়।

বিগত চুয়ান্ন বছর পর আবারও দেশ ও দেশের মানুষের নতুন অধ্যায়!
যেন বিগত দিন, মাস, বছর পর বছর আর নয়,
সর্বত্র হোক বিরাজমান সত্য ও সততার আগমন।

আলোচিত খবর

আরব আমিরাতে ভিসা সংকটে বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশি শ্রমবাজার।

সোশ্যাল শেয়ার কার্ড

এই কার্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

মধ্যপ্রাচ্যের  অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা জটিলতায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। নতুন ভিসা ইস্যু বন্ধ থাকা এবং অভ্যন্তরীণ ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও কবে ভিসা উন্মুক্ত হবে— সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারছে না বাংলাদেশ মিশন। বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আমিরাত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভিসা জটিলতা শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাব পড়ছে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধভাবে বসবাস, লিঙ্গ পরিবর্তন, সনদ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ ওঠায় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি করেছে আমিরাত সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশিরা।

এদিকে দুবাইয়ে স্কিল ভিসা চালু থাকলেও সেখানেও কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন সনদ ছাড়া বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সনদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন, পরে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের যাচাই এবং শেষে আমিরাতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। দীর্ঘ ও জটিল এ প্রক্রিয়ায় হতাশ কর্মপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ মিশনের তথ্যানুসারে, স্কিল ভিসায় সনদ জালিয়াতি ঠেকাতে তিন মাস আগে চালু করা হয়েছিল বারকোড ব্যবস্থা। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটিও জাল করে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ইউএই সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশিদের মানসিকতা না বদলালে ভিসা সংকট নিরসন সম্ভব নয়।

আবুধাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ বলেন, “গত সাত মাস ধরে ভিসা ইস্যুতে চেষ্টা চালিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।কবে হবে সেটিও অনিশ্চিত। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, তবে বিষয়টি পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ”

 

জনশক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা পরিবর্তনের জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে। অনেকেই জানেন না, ভিসা বাতিল হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যারা আমিরাতে অবস্থান করছেন, তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশি প্রবাসী সংগঠকরা মনে করেন, এ অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রবাসীদেরও ভিসা নীতিমালা মেনে চলা জরুরি। নইলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজারে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ