আজঃ শুক্রবার ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রামে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ১০ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামে একের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে কিশোর গ্যাং। এবার কিশোর গ্যাংরে ‘টর্চার সেলে’ ১০ ঘন্টা নির্যাতনের পর এক কিশোরকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নির্যাতনের শিকার আরিফ হোসেনের ভাই জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে পুলিশের দ্বারস্থ হয়। পুলিশ রাতভর অভিযান চালিয়ে কিশোরকে উদ্ধারের পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত আট জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার আট জন হলো- হেলাল বাদশা চৌধুরী (২৫), রাকিব হোসেন (২২), মো. কাউসার (২২), মেহেরাজ সামি (২১), শেখ সাদি হাসান (২০), সাগর হোসেন (২৭), আবদুর রহমান (২১) এবং সাইফুল ইসলাম শান্ত (২৬)। এই আটজনের বিরুদ্ধে আরিফের ভাই রাকিব হোসেন বাদী হয়ে একটি এবং পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেছে।
জানা গেছে, পকেটে একাধিক মোবাইল আছে বুঝতে পেরে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে জিম্মি করে মারধর শুরু করে উঠতি বয়সের কয়েক তরুণ; এলাকায় যারা ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে পরিচিত। প্রথমে তাকে চোর সাজিয়ে মারধর করে চারটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এরপর তাকে তুলে নিয়ে ‘টর্চার সেলে’ প্রায় ১০ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতনের পাশাপাশি এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। নগরীর খুলশী থানার জিইসি মোড়ে এ ঘটনার সূত্রপাত হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
খুলশী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ জানান, নগরীর জিইসি মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বাদশা একটি ‘কিশোর গ্যাং’ পরিচালনা করেন। গ্রেফতার সাত তরুণ ওই চক্রের সদস্য। এদের মধ্যে রাকিব হোসেন নিজেকে ওমরগণি এমইএস কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন।
জানা গেছে, রাকিব ছাড়া বাকিদের কেউই পড়ালেখা করেন না। তবে এমইএস কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন। মূলত এ পরিচয়েই তারা জিইসি মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
ঘটনার শিকার কিশোর বয়সী আরিফ হোসেন জানান, জিইসি মোড়ে নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে গত শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তার বড় ভাই রাকিব হোসেন অংশ নেন। ভাইয়ের খেলা দেখতে তিনি দুপুরে ওই মাঠে যান। এ সময় রাকিব তার নিজের এবং আরও দুই খেলোয়াড়ের দুটি মোবাইল আরিফকে রাখতে দেন। চারটি মোবাইল পকেটে নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ খেলা দেখেন। পরে শরবত খাওয়ার জন্য মাঠ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসেন।
আরিফ বলেন, আমি শরবত খেতে রাস্তায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদশা ও তার সঙ্গে থাকা আরও ৩/৪ জন আমার সামনে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা প্রথমে আমাকে থাপ্পড় মারে। এরপর আমাকে টেনেহিঁচড়ে তারা পাশে বাটা গলিতে নিয়ে যায়। সেখানে আরও ৩/৪ জন তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা আমাকে ঘুষি মারতে মারতে একপর্যায়ে আমার পকেট থেকে মোবাইলগুলো নিয়ে নেয়। তখন বুঝতে পারি, চারটা মোবাইল নেওয়ার কারণে আমার পকেট ফোলা ছিল। সেটা দেখে সেগুলো ছিনতাইয়ের জন্য তারা আমাকে ফলো করছিল।
তিনি বলেন, বাটা গলিতে পথচারীদের কেউ কেউ এসে আমাকে মারছে কেন, সেটা জিজ্ঞেস করেছিল। তারা বলে- আমি না কি মোবাইল চোর, মোবাইল চুরি করেছি এজন্য তারা আমাকে মারছে। এ সময় তারা আমাকে চোর সাজিয়ে মারধরের ভিডিও করে। বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে বাদশা আমাকে একটি বাইকে তুলে আকবর শাহ এলাকায় একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে রাত ১টা পর্যন্ত আমাকে আটকে রেখে মারধর করে।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ওই কিশোর আরও বলেন, একেকজন আসছিল আর আমাকে মারধর করছিল। কেউ এসে থাপ্পড় মারছে, কেউ এসে লাঠি দিয়ে মেরেছে, কেউ হাতুড়ি দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করছে, কেউ লোহার পাইপ দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। চাপাতি দিয়ে আমাকে কয়েকবার পেটে আঘাতের চেষ্টা করেছে। মাথায় অস্ত্র ধরে রেখেও আমাকে ভয় দেখিয়েছে। তখন বাদশা আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
ওসি শেখ মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ বলেন, আরিফের ভাই রাকিব তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরে ট্রিপল নাইনে ফোন দেয়। এর ভিত্তিতে আমরা অভিযান শুরু করি। বাটা গলি এবং আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে জড়িতদের শনাক্ত করি। প্রথমে আরিফকে যে বাইকে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটা বাকলিয়া এলাকা থেকে জব্দ করি এবং সঙ্গে আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করি।
তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আকবর শাহ্ থানার ইস্পাহানি রেলগেট এলাকায় পাহাড়িকা পেট্রোল পাম্পের পেছনে অভিযান চালাই। সেখান থেকে আরিফকে উদ্ধার করি এবং বাদশাসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করি। সেই জায়গাটি বাদশা ও তার সহযোগীরা মূলত টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি।
ওসি জানান, অভিযানে আরিফের ছিনিয়ে নেওয়া চারটি মোবাইল সেট, ঘটনায় ব্যবহৃত কিরিচ, লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া, হেলাল বাদশা চৌধুরীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী বাটা গলিতে অভিযান চালিয়ে একটি এলজি ও দু’টি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে।
খুলশী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল আবছার বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, আরিফের কাছে থাকা চারটি মোবাইল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে কিশোর গ্যাং লিডার বাদশা ও তার সহযোগীরা। মোবাইল দিতে না চাওয়ায় তাকে প্রথমে বাটা গলিতে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর সেগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে আবার তুলে নিয়ে আকবরশাহ এলাকায় যায়। সেখানে তাকে অন্তত ঘণ্টা দশেক অর্থাৎ আমরা উদ্ধার করা পর্যন্ত আটকে রেখে অনবরত পেটানো হয়।

শেয়ার করুন-

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

আরও খবর

কুষ্টিয়ায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বয়স্ক নারীর লাশ উদ্ধার।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় হাত–পা বাঁধা অবস্থায় খাইরুন নেছা (৬০) নামের এক বয়স্ক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে উপজেলার রামচন্দ্রপুর মানিকের বাঁধ এলাকার পাশ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত নারী হলেন ঐ এলাকার মৃত রজব আলীর মেয়ে।

পুলিশ ও স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, সকালেই মানিকের বাঁধের পাশে পানিতে ভেসে থাকা একটি লাশ দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে তাঁরা পুলিশে খবর দিলে ভেড়ামারা থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

এ বিষয়ে ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, তাঁকে হত্যা করে হাত–পা বেঁধে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। তদন্তে যা বের হবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কুষ্টিয়ায় বাড়ি থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় সোহাগ হোসেন নামের এক রাজমিস্ত্রির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুটি পিস্তল ও একটি ওয়ান শুটারগান উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ওসমানপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওসমানপুর কলপাড়া গ্রামে এই অভিযান চালান সেনাসদস্যরা। আজ শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় খোকসা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোশাররফ হোসেন এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া সেনাক্যাম্পের রওশন আরা রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিটের একটি দল ওসমানপুর গ্রামের সোহাগ হোসেন নামের এক যুবকের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় বাড়ি তল্লাশি করে দুটি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান, গুলি, দেশীয় চাকু ও হাঁসুয়া পাওয়া যায়। তবে অভিযানে কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সোহাগ হোসেন পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তাঁর বাবার নাম আশরাফ হোসেন।

পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন বলেন, সেনাবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার করা অস্ত্র থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

আলোচিত খবর

আরব আমিরাতে ভিসা সংকটে বড় হুমকির মুখে বাংলাদেশি শ্রমবাজার।

মধ্যপ্রাচ্যের  অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা জটিলতায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। নতুন ভিসা ইস্যু বন্ধ থাকা এবং অভ্যন্তরীণ ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও কবে ভিসা উন্মুক্ত হবে— সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারছে না বাংলাদেশ মিশন। বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আমিরাত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

ভিসা জটিলতা শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাব পড়ছে প্রবাসীদের কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধভাবে বসবাস, লিঙ্গ পরিবর্তন, সনদ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ ওঠায় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি করেছে আমিরাত সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশিরা।

এদিকে দুবাইয়ে স্কিল ভিসা চালু থাকলেও সেখানেও কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশন সনদ ছাড়া বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সনদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন, পরে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের যাচাই এবং শেষে আমিরাতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। দীর্ঘ ও জটিল এ প্রক্রিয়ায় হতাশ কর্মপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ মিশনের তথ্যানুসারে, স্কিল ভিসায় সনদ জালিয়াতি ঠেকাতে তিন মাস আগে চালু করা হয়েছিল বারকোড ব্যবস্থা। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সেটিও জাল করে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ইউএই সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশিদের মানসিকতা না বদলালে ভিসা সংকট নিরসন সম্ভব নয়।

আবুধাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ বলেন, “গত সাত মাস ধরে ভিসা ইস্যুতে চেষ্টা চালিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।কবে হবে সেটিও অনিশ্চিত। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, তবে বিষয়টি পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ”

 

জনশক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা পরিবর্তনের জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে। অনেকেই জানেন না, ভিসা বাতিল হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যারা আমিরাতে অবস্থান করছেন, তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

বাংলাদেশি প্রবাসী সংগঠকরা মনে করেন, এ অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রবাসীদেরও ভিসা নীতিমালা মেনে চলা জরুরি। নইলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজারে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ