
নেত্রকোনায় মদন উপজেলায় সুদের টাকায় চলছে আকাশের চিকিৎসা, খবর নেয়নি কেউ
পরিবারের হাল ধরতে কিশোর বয়স থেকেই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মিষ্টির দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ নেন মো. আকাশ মিয়া।
গত ২০ জুলাই বিকালে কাজ ফেলে সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগদেন তিনি। আন্দোলন দমাতে পুলিশ বেপরোয়াভাবে টিয়ারসেল-সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি শুরু করলে অগণিত আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয় তার চোখের সামনেই। হতাহত হয় অনেকে।
হতাহতদের রিকশা-ভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠানোর পাশাপাশি আন্দোলন চলমান রাখেন আকাশসহ অন্যান্যরা। পুলিশ তখন সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ শুরু করে। এ পর্যায়ে আর টিকতে না পেরে দৌড়ে নিজের কর্মস্থল মিষ্টির দোকানে ঢুকে শার্টার লাগিয়ে দেন। তাতেও রক্ষা হয়নি। শার্টার ভেঙে দোকানে ঢুকে আকাশের বুকে শটগান ঠেকিয়ে গুলি চালাতে উদ্যত হয় পুলিশ।
তবে পরিস্থিতি বুঝে আকাশ শটগানের নল নিচের দিকে টেলে দেয়। এতে তার হাটুর উপরে লাগে গুলিটি। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আকাশ। পুলিশ চলে গেলে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে কাছের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করা হলেও গ্রেফতার হয়রানির ভয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

লুকিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে দুইদিন চিকিৎসার পর ২৩ জুলাই রাতের আঁধারে একটি গাড়িতে করে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ততদিনে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আকাশের বাঁ পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়।
এরমধ্যে খরচ হয়ে গেছে ধার-দেনা আর সুদে আনা প্রায় ৪ লাখ টাকা। এক পা হারিয়ে এখন পঙ্গু ১৯ বছরের টগবগে যুবক আকাশ। যে স্বৈরাচার হটাতে আন্দোলনে গিয়ে পা হারিয়েছেন আকাশ, সেই স্বৈরাচারেরে পতন হয়েছে অনেক গত ৫ আগস্ট। তবে এতদিনেও (১ অক্টোবর পর্যন্ত) পঙ্গু আকাশের খবর নেয়নি কেউ।

একদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা, অন্যদিকে ঋণের বোঝা সব মিলিয়ে দিশেহারা আকাশের পরিবার। মো. আকাশ মিয়া (১৯) নেত্রকোনার মদন উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের বিয়াশি গ্রামের মো. দুলাল মিয়ার ছেলে।
চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় আকাশ। বাবা দুলাল মিয়া দিনমজুর। অভাবের সংসারে জেএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। দুই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মিষ্টির দোকানে সেলসম্যানের কাজ নেন আকাশ। এতে সংসারে অভাব ঘুছে যাচ্ছিল। এরমধ্যে পরিচিত একজনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ারও কথা হয়েছিল তার। করেছিল পাসপোর্ট। কিন্তু পুলিশের গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ তার।
যে দুপায়ের ওপর ভর করে এত বড় সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়েছিলেন আকাশ। পা হারিয়ে তিনি নিজেই পরিবারের বোঝা হয়েছেন। দুলাল মিয়ার বাড়ির জায়গা আর তাতে একটা জীর্ণ ঘর ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই।
গত বুধবার (২ অক্টোবর) আকাশ মিয়ার কৃত্রিম পা লাগানো হচ্ছে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে। বিনামূল্যে ব্র্যাক এনজিও কৃত্রিম পা লাগিয়ে দিচ্ছে বলে জানান আকাশ মিয়া।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় আকাশ বলেন, মা-বাবা ও এতগুলো ছোট ভাই বোনের ভার আমার ওপর। তারপরও সেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর হওয়া জুলুম দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। কাজ ফেলে ছাত্র জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। ওইদিন বিকেলে পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। চোখের সামনে অনেকে গুলিতে লুটিয়ে পড়ছিল। তাদের তুলে রিকশা ভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। কিন্তু আন্দোলন চলছিল।
তখন পুলিশ আরও সদস্য বৃদ্ধি করে নির্মমভাবে আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে দৌড়ে এসে আমার কর্মস্থল মিষ্টির দোকানে ঢুকে শার্টার লাগিয়ে দেই। কয়েকজন পুলিশ পিছু পিছু দৌড়ে এসে শার্টার ভেঙে দোকানে ঢুকে। আমাকে ধরে বুকে শটগান লাগিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। পরিস্থিতি বুঝে শটগানের নলটা হাতে ঠেলে নিছের দিকে নামিয়ে দেই। এতে গুলিটা বাম পায়ে লাগে। আমি মেঝেতে পড়ে গেলে পুলিশ চলে যায়। রক্তে সব ভেসে যায়।
তখন আশপাশের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে কাছের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। চিকিৎসক পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন পুলিশ আহতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছিল। সরকারি হাসপাতালে গেলে গ্রেফতার করবে সেই ভয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। গুলিতে পায়ের মূল শিরাগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল। ৩ দিন পর রাতের আঁধারে একটি গাড়িতে করে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে চিকিৎসক পা কেটে ফেলেন।
আকাশ আরও জানায়, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পা হারিয়েছি। তাতে দুঃখ নেই। স্বৈরাচার বিদায় হয়েছে। দেশ মুক্ত হয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা অন্তত আমার চিকিৎসার দায়িত্বটুকু নিক। পঙ্গু হয়ে এক হাসাপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছি। বাবা-মা এলাকা থেকে ঋণ করে সুদে টাকা এনে চিকিৎসা করাচ্ছে। দুঃখ হলো প্রায় আড়াই মাসে কেউ খবরও নিতে এলো না। কোন সহায়তাও পেলাম না। নিজের জীবনের কথা না হয় বাদ দিলাম ছোট ভাইবোন ওদের পড়াশোনা খাওয়া দাওয়া ভরণপোষণ কে চালাবে এই চিন্তা করে কষ্ট পাই। এছাড়া চিকিৎসার ঋণই বা কিভাবে শোধ হবে। বেসরকারি একটা সংস্থা থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। এছাড়া কেউ কোনও সহায়তা দেয়নি। বাড়িতে দীর্ঘদিন থেকেছি কেউ একজন সান্তনা দিতেও আসেনি। এটা আরও বড় দুঃখ।
আকাশের বাবা দুলাল মিয়া বলেন, ৪ লাখ টাকা ধার-দেনা করে সুদে এনে চিকিৎসা করিয়েছি। পা কাটা নিয়ে ছেলেটা গ্রামের বাড়িতে শুয়ে রয়েছে। এই আড়াই মাসে কেউ খবরও নেয়নি। পাইনি কোনো সহায়তা। গরীব মানুষ কোন জমিজমা নেই। ছেলেটার আয় দিয়েই পরিবারের খরচ চলতো। এখন তার পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকা সুদে আনতে হয়েছে। ছেলের জীবন তো শেষ। উল্টো ঋণের বোঝা কাঁধে। আল্লাহ জানেন এই ছেলে মেয়েগুলো নিয়ে কিভাবে চলব। দু’চোখে অন্ধকার দেখছি।
দুলাল মিয়া আরও বলেন, এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আকাশকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। ইতিমধ্যে তার পাসপোর্টও করেছিলাম। সব স্বপ্নই তো শেষ। দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমার ছেলে পা হারিয়েছে। দেশ মুক্ত হলো কিন্তু কেউ তার চিকিৎসার ভার নেইনি। খোঁজখবর নেয়নি। আর্থিক সহায়তাও করলো না কেউ। ছেলেটাকে দেখে স্বান্তনা দিতেও বাড়িতে এতদিনে কেউ আসেনি। দুঃখ শুধু এটুকুই।












