
আমিহীন সেদিনের পৃথিবী
এই নশ্বর ধরায় কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয়। যেটা একবার উদিত হয়েছে সেটার গত হওয়া যেন অবশ্যম্ভাবী। তবুও এই মর্ত্যলোকে আমাদের জল্পনা-কল্পনা একটুর জন্যও থেমে নেই। জাগতিক এই মিথ্যা কুহকের কাছে ধরাশায়ী হয়ে আমরা উদ্ভাবন করে বসি প্রথিত হওয়ার ঠুনকো উপায়৷ পরিবার, সমাজ ও জনতার কাছে নিজের সর্বাগ্রগণ্য তুলে ধরতে মরিয়া হয়ে পড়ি। স্বীয় স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্বের বিসর্জন দিতে দিতে ভুলে বসি আমিহীন পৃথিবীর বহমানতাকে।দাম্ভিকতা ও দুনিয়াবি ধোঁকার করাঘাতে দুমড়েমুচড়ে নিজেই নিজের মূলোৎপাটন ডেকে আনি, ভেবে বসি আমার অনুপস্থিতি কাঁদাবে এই পার্থিব মহলকে। কিন্তু তা কি করে হয়? পৃথিবী যে তার নিজ বিধি মোতাবেক অগ্রসরমাণ। দেখো অয়োময় এই কৃষ্ণগহ্বরে দুনিয়ার উজ্জ্বল কিংবদন্তি (ব্যাক্তিত্ব) নক্ষত্রগুলো হারিয়েও পৃথিবী দেদারসে চলে আসছে হাজার বছর ধরে।সেখানে আমার মতো কিঞ্চিৎ এই তুচ্ছ অনুদার সৃষ্টির স্থায়িত্ব ও মনে রাখার যুক্তি উদয়ন করা একান্তই অবাঞ্ছনীয়। আমিহীন সেই পৃথিবী সেদিন কেমন হবে তা কি কখনো অনুভব করি আমরা। হয়তো এভাবে…

এই বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ সেদিন থেকে যাবে, থেকে যাবে ধোঁয়া ওঠা এই চায়ের কাপের উষ্ণতা, এই বিরান প্রান্তরের পিনপতনতা সেদিন থেকে যাবে, থেকে যাবে এই মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা, তাতে প্রত্যহ পালা করে এভাবে আঁধার পেরিয়ে সুবহে সাদিক আসবে, থেকে যাবে এই ঝলসানো চাঁদ যার আলোয় আলোকিত হবে দিগ্বিদিক, নিত্যদিনের মতো এই ঝরা পাতা সেদিনও শুকিয়ে কাঠ হবে, সেদিনও শহরজুড়ে বৃষ্টি আসবে পাখিরা খুঁজবে আশ্রয়, থেকে যাবে সেই জলপতনের রিমিঝিমি কলতান, থেকে যাবে এই দূর্বাঘাসকে আঁকড়ে থাকা পরিচিত মাটির মৃদু গন্ধ, থেকে যাবে দিগন্তে ভেসে আসা নিশীথ রাতের ডাহুকের ডাক, থেকে যাবে এই গোঙানি দেওয়া যন্ত্রমানব রেলগাড়ী, তাতে পালা করে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিবে আমার মতই কোনো এক দুরন্ত কিশোর, রয়ে যাবে এই হাসনাহেনা আর রজনীগন্ধার ঘ্রাণের রাজ্য, থেকে যাবে আমাবস্যার এই ঘুটঘুটে আঁধার, থেকে যাবে শরতের ঝকঝকে রাতের আকাশের তারাগুলো, থেকে যাবে বাবুই আর চড়ুইয়ের বাসা, তাতে পালা করে বসবাস করবে তাদেরই কোনো এক প্রজন্ম, থেকে যাবে সন্তানের নিমিত্তে মায়ের ভালোবাসা, থেকে যাবে শর্বরীতে লেপ্টে থাকা জোনাকির দলেরা, থেকে যাবে আমার পরিচিতি প্রান্তর, এদিনের মতো সেদিনও অজপাড়াগাঁয়ের মিনার থেকে ভেসে আসবে বৃদ্ধ মুয়াজ্জিনের তিরতির করে কাঁপা আজানের বার্তা, তাতে সাড়া দিয়ে স্রষ্টার স্তুতিতে উপনীত হবে কোনো এক আমজনতা, থেকে যাবে আমার ঝুলি ভর্তি স্মৃতিগুলো, থেকে যাবে এই দরদ মিশ্রিত সুর, থেকে যাবে আমার কোনো এক উত্তরসূরী …..
শুধু সেদিন থাকবে না কে ?
কেবল আমি নামক হতভাগা। মৃত্যু নির্মম, সে যে অদম্য, আমার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার আবির্ভাব অবধারিত। আমি মৃত্যুর পথেই সর্বদা চলমান, এই হেঁটে চলা অদৃশ্যমান,অজ্ঞাত। কোনো একদিন লাগাম ছেঁড়া ঘোড়ার ন্যায় গোঙানি দিয়ে হাজির হবে সে, আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরবে আমায় চতুর্দিক থেকে, মিশিয়ে দিবে আমার অস্তিত্ব এক অদৃশ্য জগতে, সে জগৎ কেবল মৃতদের কাছে দৃশ্যমান। আমি হারিয়ে যাবো কোনো এক ক্ষণে, হারিয়ে যাবো ওই চাঁদটার মতো না, হারিয়ে যাবো ঠিক আজীবনের জন্য।
